ক্রোয়েশিয়ার সোনালি প্রজন্ম কি পারবে রাশিয়া বিশ্বকাপ জিততে?

ফুটবলে বড় দলের নাম বললেই প্রথমে চলে আসে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইতালির মতো ফুটবল দলগুলোর কথা। কিন্তু ছোট ও মাঝারি দলগুলোও অনেক সময় পেয়ে যায় দুর্দান্ত সব সোনালি প্রজন্মের দল। গত বিশ্বকাপে ভ্যান পার্সি, আরিয়েন রোবেন, ওয়েসলি স্নাইডারদের নিয়ে গড়া দল পেয়েছিল ডাচরা। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ের সৌভাগ্য তাদের হয়নি। এবার ক্রোয়েশিয়া দলটিতে আছে ইভান রাকিটিচ, লুকা মদ্রিচ, মারিও মানজুকিচ, পেরিসিচদের মতো তারকা খেলোয়াড়। ডেনমার্ককে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যাওয়া এই সোনালি প্রজন্মের জন্য এবারই বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছে।

এবারের বিশ্বকাপের শিরোপার মূল দাবিদার হিসেবে ক্রোয়েশিয়া আসেনি। কিন্তু তারকা খেলোয়াড়ে ভরা দলটির বিশ্বকাপ জয়ের সামর্থ্য নিয়ে কারও সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণভাগে আছে লোভ্রেন, ভিদা। মাঝমাঠে রয়েছেন বর্তমান বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচ। তার সাথে আছে আছেন বার্সেলোনার তারকা মিডফিল্ডার ইভান রাকিটিচ, ইন্টার মিলানের মিডফিল্ডার ব্রজোভিচ, রিয়াল মাদ্রিদের মাতেও কোভাসিচ। আক্রমণভাগে জুভেন্টাসের মারিও মানজুকিচ ও ইন্টার মিলানের পেরিসিচের মতো তারকা ফুটবলার। নিজেদের দিনে দলটি বিশ্বের যেকোন দলকে সামর্থ্য রাখে।

ক্রোয়েশিয়ার দুই ভরসার প্রতীক আকিতিচ ও মদ্রিচ; source: deccanchronicle.com

ক্রোয়েশিয়ার বর্তমান দলের সব থেকে বড় শক্তির জায়গা হলো তাদের মাঝমাঠ। অনেকের মতে, এবারের বিশ্বকাপের সেরা মিডফিল্ড তাদের। ৪-২-৩-১ ছকে খেলে ক্রোয়েশিয়া। লুকা মদ্রিচ, ইভান রাকিতিচ ও ব্রোজভিচ মাঝমাঠে খেলেন। ইভান রাকিটিচ ও লুকা মদ্রিচ শর্ট ও লং পাস দুই দিকেই সমান দক্ষ। এবারের বিশ্বকাপে রাকিতিচ ও মদ্রিচকে ডাবল পিভট রোলে খেলতে দেখা যাচ্ছে।

মাঝমাঠে ব্রজোভিচের উপস্থিতি এই দুই তারকা মিডফিল্ডারকে প্লে-মেকিং করার জন্য স্বাধীনতা দিয়ে দেয়। ফলে ক্রোয়েশিয়া আক্রমণের জন্য প্রচুর সুযোগ তৈরি করতে পারে। উইঙ্গার পেরিসিচ আর ফিনিশিং করার সময় মারিও মানজুকিচের উপস্থিতি দলকে পূর্ণতা দিয়েছে। রক্ষণভাগে ক্রোয়েশিয়া কিছুটা দুর্বল দলটি। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে ভালই রক্ষণভাগ সামলেছে ক্রোয়েশিয়া। ৪ ম্যাচে মাত্র ২টি গোল হজম করেছে ভিদা, লোভ্রেনরা।

গোল উদযাপনে ক্রোয়েশিয়া; source: standard.co.uk

বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার গ্রুপে পড়ে আর্জেন্টিনা, নাইজেরিয়া ও আইসল্যান্ড। প্রথম ম্যাচে নাইজেরিয়াকে ২-০ হারায় ক্রোয়েশিয়া। লুকা মদ্রিচ ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন। এরপরের ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলের ব্যবধানে পরাস্ত করে। আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক আর্মানির ভুলকে কাজে লাগিয়ে ২য় অর্ধের শুরুতেই গোল  করে নেন রেবিচ।

এরপর লুকা মদ্রিচ দূরপাল্লার এক শটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন। খেলার শেষ দিকে ইভান রাকিটিচের গোলে আর্জেন্টিনাকে বিধ্বস্ত করে মদ্রিচ-রাকিটিচরা। আর্জেন্টিনাকে নিয়ে ছেলেখেলা করা ক্রোয়েশিয়া গ্রুপের শেষ ম্যাচেও আইসল্যান্ডের বিপক্ষে জয় তুলে নেয়। এরই সাথে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরের রাউন্ড নিশ্চিত করে তারা।

২য় রাউন্ডে ক্রোয়েশিয়ার প্রতিপক্ষ ছিল ডেনমার্ক। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে শেষ হওয়া খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত ৩০ মিনিট সময়ে কোনো দলই গোল করতে সক্ষম না হলে টাইব্রেকারে খেলা গড়ায়। টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়া শেষ পর্যন্ত জয়ের হাসি নিয়েই মাঠ ছাড়ে।

পেনাল্টিতে গোল করছেন মদ্রিচ; source: hindustantimes.com

২য় রাউন্ডের খেলা শেষ কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হবে ফ্রান্স-উরুগুয়ে, ব্রাজিল-বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড-সুইডেন। অন্যদিকে ক্রোয়েশিয়া প্রতিপক্ষ হিসেবে পাবে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে সহজ প্রতিপক্ষ রাশিয়াকে। রাশিয়া ২য় রাউন্ডে ফ্যাবারিট স্পেনকে বিদায় করে পরের রাউন্ডে উঠেছে। কিন্তু স্পেনকেই ২০১৬ সালের ইউরোতে গ্রুপ পর্বের খেলায় হারিয়ে ক্রোয়েশিয়া বিদায় করে দিয়েছিল। রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয় পেলে সেমি-ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ায় সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ হতে পারে ইংল্যান্ড অথবা সুইডেন।

অর্থাৎ ফাইনালে ওঠার পথে ক্রোয়েশিয়ার রাস্তা সবচেয়ে সহজ। ফাইনালের আগে পর্যন্ত  ব্রাজিল, বেলজিয়াম উরুগুয়ে ও ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী দলগুলোর সাথে খেলা পড়ার কোনো সুযোগ নেই। রাশিয়া, স্পেনের মতো বড় দলের বিদায় নেওয়ার অঘটন তাই ফাইনালে উঠার রাস্তা সহজ করে দিয়েছে লুকা মদ্রিচ, ইভান রাকিটিচদের জন্য। নিজেদের দিনে ক্রোয়েশিয়া পৃথিবীর যেকোনো দলকে হারানোর সামর্থ্য রাখে ক্রোয়েশিয়া। ফলে ক্রোয়েশিয়ার সোনালি প্রজন্মের জন্য এই বিশ্বকাপ হতে পারে দেশকে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে ভাসানোর শ্রেষ্ঠ সুযোগ।

ক্রোয়েশিয়া দলের উদযাপন; source: standard.co.uk

ক্রোয়েশিয়া দেশটি আগে ছিল যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্ভুক্ত। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়ার পর অনেকগুলো দেশ তৈরি হয় যার একটি ছিল ক্রোয়েশিয়া। স্বাধীন দেশ হিসেবে ১৯৯৮ সালে প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। এরপর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবারই বিশ্বকাপের মূল পর্বে উঠতে পড়েছে ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের সময়ও একটি সোনালি প্রজন্ম পেয়েছিল ভেট্রেনিরা। আসানোভিচ, বোবান, রোবার্ট প্রসিনেকি, সুকারেরদের নিয়ে দলটি গড়া ছিল।

৯৮’ এর ক্রোয়েশিয়া ফুটবল দল; source: .croatiaweek.com

ফ্রান্সের কাছে সেমি ফাইনালে ২-১ গোলে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল তাদের। কিন্তু সুন্দর ফুটবল খেলে দর্শদের মন ঠিকই জয় করে নিয়েছিল তারা সুকার, আসানোভিচরা।

এবারের বিশ্বকাপে আরজেন্টিনার বিপক্ষে জয়ের পর ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্ডার লোভ্রেন বলেছিলেন, “আমরা ১৯৯৮ সালের দলটির থেকেও ভাল কিছু করতে পারি।” এই প্রসঙ্গে পেরিসিচ এক মন্তব্যে বলেন,” তারা (‘৯৮ এর দলটি) ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে অনেক বড় চমক দেখিয়ে ছিল। আমার বয়স তখন ছিল ৯ বছর। ঐ খেলাগুলো দেখতাম আর নিজেকে এই জায়গায় দেখার স্বপ্ন দেখতাম।” ডেনমার্কের বিরুদ্ধে জয়ের পর ক্রোয়েশিয়ার ভিদা বিশ্বকাপ জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ জানিয়েছেন।

তুলনামূলকভাবে সহজ ফিকচার আর নিজেদের সামর্থ্য ক্রোয়েশিয়াকে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। যদি বিশ্বকাপ জিতে নিতে পারে তবে ফুটবল ইতিহাসে ক্রোয়েশিয়ার সোনালি প্রজন্মের এই দলটির নাম সবসময় উচ্চারিত হবে।

 

featured image: mykhel.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *