“খালিদের ইয়ারমুখ যুদ্ধ” – কিস্তিঃ দুই : মেজর ডি এইচ খান

কিস্তিঃ এক

কনফারেন্স রুম জুড়ে পিন পতন নিস্তব্ধতা; অবশেষে আবু উবায়দা সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খালিদের পরামর্শ চাইলেন। প্রথমেই খালিদ গোয়ান্দা প্রধানদের কাছ থেকে সর্বশেষ ইন্টেলিজেন্স আপডেট জানতে চাইলেন। বাইজান্টাইন রোমান যুদ্ধবন্দী আর এমেসায় সদ্য রিক্রুটেড ডাবল এজেন্টদের মাধ্যমে পাওয়া ইন্টেলিজেন্সের ভিত্তিতে ওয়ার গেমিং টেবিল জুড়ে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের রণ পরিকল্পনার যে চিত্রটা ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে উঠছে তা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ।

৬২৯ সালে সম্রাট হিরাক্লিয়াস গ্রিক টাইটেল ‘ব্যসিলিও’ গ্রহনের পর থেকেই তার প্রপাগান্ডিস্টরা যেকোন বাইজান্টাইন এফোর্টকেই যীশুর নামে চালিয়ে দিচ্ছিল, যুদ্ধক্ষেত্রে রেলিক হিসেবে যীশুর ক্রুশের কাঠ বহন করা হত সৈন্যদের মোরাল আপ রাখতে। এবারও এর কোন ব্যতিক্রম হলনা। ৬৩৫ সালের শেষ দিকে সম্রাট হিরাক্লিয়াস প্রায় অপ্রতিরোধ্য ইসলামিক ইনভেনশনস ঠেকাতে এই আদি ক্রুসেডের ডাক দিলেন। যদিও সিরিয়ান ফ্রন্টে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছিল না, আর মুসলিমদের হাতে এমেসা নগরী তখনও পর্যন্ত অবরুদ্ধ।

মে ৬৩৬ নাগাদ এমেসাবাসী যখন জিজিয়া কর দিয়ে মুসলিম আর্মির বশ্যতা মেনে নিতে রাজি হয়েছে, তখন উত্তর সিরিয়া আর আরো উত্তরে এন্টিওখ জুড়ে রাশান, স্লাভ, ফ্রাঙ্ক, গ্রীক, রোমান, জর্জিয়ান, আর্মেনিয়ান আর খ্রিস্টান আরবদের নিয়ে গড়ে ওঠা বাইজান্টাইন বহুজাতিক বাহিনী রণপোম নিতে শুরু করেছে।

৩০,০০০ সেনা নিয়ে একেকটা বাইজান্টাইন আর্মি গড়ে উঠল, আর এমন ৫টা আর্মি একযোগে এগুতে লাগল সিরিয়ান ফ্রন্টের দিকে। আর্মেনীয়দের কমান্ড করছিল জেনারেল ভাহান, মতান্তরে রাজা মাহান। এমেসার সাবেক এই গভর্নর নিজের হাতের তালুর মতই ভাল করে চিনতেন সিরিয়ান ফ্রন্টের আনাচে কানাচে। খ্রিস্টান আরবদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন প্রিন্স জাবালাহ। রাশান আর স্লাভদের কমান্ডে ছিলেন জেনারেল কানাতীর। আর অল ইউরোপিয়ান ফোর্স কমান্ড করছিলেন জেনারেল গ্রেগরি আর জেনারেল দাইরজান।

ভাহানকে ফিল্ড কমান্ড দেয়া হল আর থিওডোর টিথোরিয়াস কে বাইজান্টাইন বহুজাতিক বাহিনীর প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হল। টিথোরিয়াস আদতে ছিলেন বাইজান্টাইন কোষাধ্যক্ষ। সিরিয়ান ফ্রন্টে তাকে পাঠানর কারন ছিল দ্বিবিধ। প্রথমত আর্মেনিয় জেনারেল ভাহানের সাথে ইউরোপিয় কমান্ডার আর জেনারেলদের পার্সোনালিটি কনফ্লিক্ট রিডাকশন। আর দ্বিতীয়ত বিশাল এই বহুজাতিক বাহিনীতে যেন বেতন পাওয়া নিয়ে কোন রিউমার না ছড়ায়।

তখন খেলাফতের মুসলিম আর্মি চার ভাগে বিভক্ত হয়ে তিন ফ্রন্ট জুড়ে অভিযানে ব্যস্ত। আমর বিন আল আস প্যালেস্টাইনে, সুরাবিল জর্ডানে, কাসেরিতে ইয়াজিদ আর আবু উবায়দা ও খালিদ এমেসার উত্তরে লড়ছিল তখন। হিরাক্লিয়াস মুসলিম আর্মির এই স্প্লিট কন্ডিশনের ফায়দা লুটবার ফন্দি আটলেন। তিনি চাইলেন তার বিশাল এই বহুজাতিক বাহিনী দিয়ে একের পর এক মুসলিম আর্মিকে আউটনাম্বার করে গুড়িয়ে দিতে। প্রায় অবিশ্বাস্য বেলিজারেন্ট রেশিওর জন্যও ইয়ারমুখের যুদ্ধের নাম ইতিহাসের পাতায় লিখা হতে চলেছে।

ওদিকে উমর বনাম খালিদের বিরোধ নিয়ে কানাঘুষা তখন তুঙ্গে। অনেকেরই ধারনা ব্যাপারটা ঈর্ষাজনিত। তুতো ভাই খালিদের কাছে শৈশবে অসংখ্যবার মল্লযুদ্ধে পরাজিত উমর ক্ষমতায় এসে তার শোধ নিয়েছেন। দুজনই সাহাবী ছিলেন, ইসলামের বিস্তারে দুজনই মহানবী (সাঃ) এর কাছে প্রায় অপরিহার্য ছিলেন। তাই একটা ঈর্ষার অস্তিত্ব একেবারে উড়িয়ে দেবার জো ছিল না। কিন্তু একটা জায়গায় এসে দুই জন দুই ভাবে অনন্য, খালিদ ছিলেন ফাইনেস্ট ট্যাকটিক্যাল কমান্ডার আর উমর ছিলেন স্ট্রেটেজিক্যালি সাউন্ড অনবদ্য এক স্টেটসম্যান।

উমরের দাবী লিভিং লিজেন্ড খালিদের ব্যাপারে মুসলিমদের মনে ক্রমেই দৃঢ় হতে থাকা কুসংস্কার থেকে ইসলামকে বাঁচাতেই খালিদকে কমান্ড থেকে অপসারনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। লোকে ভাবতে শুরু করেছিল খালিদ যুদ্ধক্ষেত্রে পা রাখা মানেই সুনিশ্চিত বিজয়!

কিন্ত আসন্ন ইয়ারমুখের যুদ্ধে দুজনেই স্ট্রেটেজিক আর ট্যাকটিক্যাল পারভিউ থেকে দারুনভাবে লড়েছিলেন, আর হিরাক্লিয়াস – ভাহানের বহুজাতিক বাইজান্টাইন বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করে বেলিজারেন্ট রেশিওর ঐতিহাসিক হিসেব নিকেশ আগাগোড়াই উল্টে পাল্টে দিয়ে ছিলেন।

(ক্রমশ…)

Writer : Major Del H Khan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *