তোমরা যারা মেডিক্যালে চান্স পাওনি
ডা. মোঃ আবু ইমরান
এফসিপিএস (সার্জারি)
[ শেষ পর্ব]
এরপর থেকে সেই পিলো (বালিশ) ড্রামার বড়ভাইয়ের দেখানো পথে চলতে থাকলাম। তিনি বললেন, মাহবুব ভাই থেকে যেনো 100 হাত নিরাপদ দূরত্বে থাকি। কারণ সে নাকি সন্ত্রাসী। একে-47 রাইফেন নাকি তার জিন্সের ভিতরে বান্ধা থাকে। পাঠক, এখানে বলে রাখি, 1998 সালে আমাদের হাতে মোবাইল, ইন্টারনেট ছিল না; ছিলনা গুগল । কাজেই বড়ভাইরা যে-যা বলতো সেটাকেই উইকিপিডিয়া ভেবে বসে থাকতাম।
ড্রামার ভাই আরও বললেন, নরমাল প্যান্ট, পায়ের গিরার উপরে উঠে আছে এরকম কাউরে দেখলেই বুঝবি শিবির। ঘরে তাবলীগ আইলে কইবি, ভাই একটা গান শুইন্না যান। গিটার বাইর কইরা গান শুরু করবি। এমনি হাজার নির্দেশনা। তবে তার কোনো উপদেশই কাজে লাগেনি।
একদিন তাবলীগের আমির সাহেব এলো তার বয়ান দেবার উদ্দেশ্যে। আমি তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গিটার বের করে গান শুরু করলাম- ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা…’। আমির সাহেবের সাথে উপস্থিত সিরাজ ভাই, মিলন ভাইসহ আরো কয়েকজন মন্ত্রমুগ্ধের মতো গান শুনলো। যেনো তারা অনেক কষ্টের মাঝে একটু রিলিফ পেলো। যেনো শুষ্ক মরুভূমিতে কয়েকফোঁটা বৃষ্টি বর্ষিত হলো। গান শেষ করার পর তাবলীগের আমির সাহেব নরোম কণ্ঠে বললেন, আহ্! কী মিষ্টি কণ্ঠ। এই কণ্ঠে আযান না-জানি কতো সুন্দর হবে!
আমি তার প্রশংসার সিক্ত হয়ে বললাম, জ্বি আমির সা’ব।
তখন তিনি প্রস্তাব করলেন, আজ তাহলে সালাতুল মাগরেবের পর একটু বসি।
আমি ইনশাআল্লাহ বলে সেখান থেকে প্রস্তান করি। এরপর কখনো আমির সাবের সাথে বসা হয়নি।
পরীক্ষার পূর্বে সবাই যখন লেঞ্জা গুটিয়ে গর্তে ঢুকে পড়ে, পলিটিক্যাল ভায়েরা দিনে ঘুমোয়, রাতে পড়ে আমিও তখন একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো গিটার ছেড়ে রুটিন করে পড়ি আর ৫ ওয়াক্ত মসজিদে হাজিরা দেই। হাজিরা দিয়ে বলি, হে ক্ষমাশীল! শুধু এইবার ক্ষমা করো প্রভূ! আর এরকম ভুল হবে না। এবার শুধু বাঁচিয়ে দাও মালিক। তারপর দেখো- তোমার পথ ছাড়া যদি আমি অন্যকোথাও যাই তাহলে কান কেটে কুত্তারে খাওয়ামু। আমারে বিশ্বাস করো খোদা, আমি আগে নাফরমানি করতে পারি কিন্তু কথা দিচ্ছি ফারদার আর করবো না। এবার খালি কোন রকমে পাশ করাইয়া দাও মাওলা!
এক পরীক্ষার সিজনে মাগরেবের নামায পড়ে বেরিয়ে আসার সময় কিছু তাবলীগীরা আমাকে কট করে ফেললো। আমিও সেদিন কিছুটা ইচ্ছা করেই তাদের সাথে বসলাম। উদ্দেশ্য- তাদের কর্মকান্ড এবং তারা সেখানে কী আলোচনা করে তা দেখা। বসে দেখলাম তারা কিছু হাদিস আলোচনা করলো। তারপর কে-কে আল্লাহর পথে ৩দিন (সময়) লাগাবেন সেবিষয়ে সিলেকশন শুরু হলো।
সবাই মিলে আমাকে এমনভাবে ছাই দিয়ে ধরলো যে, আমি আর পিছলাইতে পারলাম না। অতঃপর ৩দিনের সেই মিশন-এ গেলাম। গিয়ে একরাত পার করেই রীতিমতো পালিয়ে আসলাম। বলে রাখা প্রয়োজন, অনেক মানুষের চিল্লা ব্যাপারটা ভালো লাগে। তারা দিনের পর দিন সেখানে কাটায়। বৃহৎ আকারে ৪০ দিনের চিল্লা লাগায় কিন্তু আমি সেটা পারিনি।
যাই হোক, মাহবুব ভাইয়ের কথা যখন উঠলোই তার কিছু বর্ণনা দিই। মানুষটা ফর্সা, সুন্দর, মার্জিত, নম্রভাষী। হোস্টেল লাইফে কখনো তার ধারে ঘেষতাম না। কারণ, মেডিক্যাল কলেজ লাইফের শুরুতেই আমাকে এমনভাবে মোটিভেইট করা হয়েছিল যে, আমি ভেবে বসেছিলাম- মাহবুব ভাই একজন মস্ত সন্ত্রাসী। প্যান্টের ভিতর একে-47 না থাকলেও পিস্তল তো আছেই। বস্তুতঃ তার মতো ভদ্রলোক আর দ্বিতীয়টি আমি দেখিনি। তিনি ঝামেলা-কেওয়াজ কখনোই পছন্দ করতেন না।
দুঃখজনক হলেও সত্যি ছাত্রজীবনে কিছুটা বিপথে চলে যাওয়ার কারণে মুক্তাভাই, নোবেল ভাই, নাজমুল ভাইদের মতো ভীষণ ভালোমানুষগুলোর কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে বুঝেছি উনাদের সহচর্য় পেলে হয়তো আমি আরও ভালো কিছু করতে পারতাম।
সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে যে উদ্দেশ্যে এই লেখাটা লেখা শুরু করেছি তাহলো- তোমরা যারা মেডিক্যালে চান্স পাওনি তারা মেডিক্যাল হোস্টেলের গ্রুপিং রাজনীতির যন্ত্রণা থেকে যে কত বড় বাঁচা বেছে গেছো তা তোমাদের ভাষায় প্রকাশ করে বোঝাতে পারবো না। বিধাতা নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য সুন্দর জীবন রেখেছেন।
আমাদের ক্লোজ ফ্রেন্ডদের মধ্যে আমিই শুধু মেডিক্যালে ঢুকলাম। বাকিরা সবাই গেলো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। একেকজন একেক বিভাগে। তাদের মধ্যে তো একজন এখন বিশ্বসেরা। তার নাম লিখে তাকে বিব্রত করতে চাই না। শুধু এটুকুই বলতে চাচ্ছি, যাদের ডাক্তারি পেশায় আসা হয়নি, তারা যেনো ভুলেও এটাকে হতাশা হিসেবে না নেয়। কারণ, তোমাদের একটি দরজায় তালা পড়েছে তো কী হয়েছে, বাকি অনেকগুলো দরজাতো আকাশের মতো অবারিত। শুধু বিশ্বাস রেখো মনে- হাল ধরে থাকলে কিণার খুঁজে পাবেই পাবে। জয় তোমাদের একদিন হবেই হবে।
আমার এক বন্ধুর ঘটনা বলি। সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলো। যথারীতি এমবিবিএস পাশ করলো, ২৫তম বিসিএসে ঢুকলো। কিছুদিন চাকুরি করে চাকুরি ছেড়ে দিলো। হ্যাঁ, আপনারা যারা বিসিএস প্রিপারেশন নেন এমপি-3, জর্জ সিরিজ পড়েন। সেই ডাঃ শাহনেওয়াজ জর্জের কথা বলছি। ডাক্তারি পড়েও সে ডাক্তারি করছে না। তাতে তার সুখের অভাব হয়নি। সুন্দরী বউ, বাড়ি, গাড়ি কোনো কিছুরই অভাব নেই তার।
আমরা সবাই জানি, চাকুরির বাজারে বিসিএস এখনো তার দাম ধরে রেখেছে। পররাষ্ট্র, প্রশাসন ক্যাডারগুলো তো এককথায় লোভনীয়। মেডিক্যালে হয়নি তো কী হয়েছে এখন থেকে প্রস্তুতি নিয়ে অন্য ক্যাডারে ঢুকে পড়ো। ঢাবি, চবি, শাবি বা তোমার বাড়ির কাছে যেটা আছে সেটায় ভর্তি হও। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলেও ক্ষতি নেই। কলেজে অনার্স পড়ো। মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে পাশ করো। অতঃপর বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকুরিতে ঢুকে পড়ো। তখন সকলের মধ্যমণি হয়ে উঠতে সময় লাগবে না।
প্রিয় পাঠক এবং মেডিকেলে ভর্তি হতে না পারা শিক্ষার্থী, আমি লেখাটা দ্রুত শেষ করতে চাচ্ছি, কারণ ২দিন আগের গৃহপরিচারিকার মোবাইল কেনার ঘটনা নিয়ে বাসায় যে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তার রেশ এখনো কাটেনি।
সেই ড্রামার ভাইয়ের কথা ফিরে আসি। একদিন সন্ধ্যায় আমি হাত-মুখ ধুয়ে চা-নাস্তা খেয়ে, বিসমিল্লাহ্ বলে পড়তে বসেছি। প্ল্যান ছিল একটানা রাত ১০টা পর্য়ন্ত পড়বো। কিন্তু ৫ মিনিট যেতে না যেতেই সেই ড্রামার বড়ভাই এসে দরজায় উঁকি মেরে বললেন, ‘কী রে! পড়ছিস নাকি? তোর তো ভবিষ্যত অন্ধকার’- এই বলে পিছনের পকেট থেকে ড্রামস্টিক বের করে বালিশ নিয়ে পজিশন নিয়ে বসে পড়লেন।
আমি কিছুটা ইতস্তত করে বললাম, ‘ভাই! কাইল আইটেম।’
তিনি মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বললেন, ‘আইটেম?!?’ এরপর খিক্-খিক্-খিক্ করে হেসে বললেন, ‘তুই পুরাই গ্যাছোছ! সন্ধান ভাই তোর মাথা নষ্ট করছে, নাহ্?’
আমি আশ্চর্য় হয়ে বললাম, ‘সন্ধান ভাইটা কে ভাই?’
তিনি চোখ রাঙিয়ে বললেন, আবার মিছা কথা কস? একলগে চা খাইলি দেখলাম। থার্টি এইটের পাঁয়তার সন্ধান- মাথায় কিচ্ছু নাই। মাইয়াগো নজরে পড়ার লাইগা সারাদিন লাইব্রেরিতে পইড়্যা থাকে, তার লগে চললে কিন্তু তুই এক্কেরে পঁইচা যাবি কইলাম।
আমি অস্বীকারের সুরে বললাম, না ভাই! উত্তরবঙ্গের বড়ভাই তিনি। পরিচিত হইলাম মাত্র। কইছে- প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করলে নাকি পরীক্ষার আগে কষ্ট হইবো না। আর কইছে- কোনো কিছু না বুঝলে তার রুমে যাইতে।
তিনি তখন চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, সর্বনাশ! খবরদার, তার রুমে যাবি না। তুই জানোস, ওয় একটা হোমো?
আমিও ভ্রু কুঁচকে বললাম, হোমো কী ভাই?
তিনি তখন দুষ্ট হাসি দিয়ে রাশভারী গলায় বললেন, হোমো তোর বোঝা লাগবো না। চিটাগাং যখন আয়া পড়ছস তখন অটো শিইক্কা যাইবি।
আমি ‘জ্বি ভাই’ বলে পড়ায় মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু তিনি কিছুটা হুংকার দিয়ে বললেন, ওই তুই কি ক্যাচাল কইরা সময় নষ্ট করবি? নাকি আমার লগে প্র্যাকটিস করবি?
আমি আর তাকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না। বললাম, না ভাই। সময় নষ্ট করার কাম নাই। চলেন প্র্যাকটিস করি। মিউজিক ছাড়া বাঁচুম না ভাই। পরীক্ষা তো জীবনে বারবার আইবো কিন্তু মিউজিকের সময় একবার চলে গেলে আর আইবো না ভাই।
একথা শুনেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তিনি তখন উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বললেন, তাইলে এক কাম কর। গিটারটা ল। আমার রুমে চল। ড্রাম সেট কইরা রাখছি। আইজ সারা রাইত গান হবে, ভাবের গান। কাম’অন রক এন’ রুল…। [সমাপ্ত]