ভালো বিপদেই পড়েছে বাংলাদেশ দল!
বিশ্বমঞ্চে প্রথম সেমিফাইনাল। কোথায় সেটি উদ্যাপনের উপলক্ষ হবে, উল্টো সেটি ভুলে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করতে হচ্ছে!
তামিম ইকবাল তো এই ম্যাচে ভালো করার পূর্বশর্তই বানিয়ে দিলেন এটিকে, ‘যদি আমরা সেমিফাইনাল ভেবে খেলি, তাহলে পারব না। যদি আরেকটা ম্যাচ ভেবে খেলি, তাহলে ভালো খেলব।’ গত পরশু রাতে টিম হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে তামিমের কথাটাই যেন কাল সংবাদ সম্মেলনে প্রতিধ্বনিত হলো মাশরাফি বিন মুর্তজার কণ্ঠে।
বোঝাই যাচ্ছে, এটা আসলে দলীয় সিদ্ধান্ত—ভুলে যাও এটা সেমিফাইনাল। এটা স্রেফ আরেকটা ম্যাচ। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আজ এজবাস্টনের সেমিফাইনালে বিরাট কোহলির দল তো পরে আসবে। আসল লড়াইটা মাঠে নামার আগেই—সেমিফাইনালের চাপ মাথায় চেপে বসতে না দেওয়া।
পরিবেশ-পরিস্থিতি যেটির মোটেই অনুকূলে নয়। ক্রিকেটাররা হায়াত রিজেন্সি হোটেলের বাইরে এসে দাঁড়ানোমাত্র প্রবাসী বাংলাদেশিরা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। জানিয়ে দিচ্ছেন চাওয়াটা, ‘সেমিফাইনালে যখন উঠেছেন, ফাইনালে যেতেই হবে।’ প্রতিপক্ষ ভারত বলে কারও কারও দাবি আরও সুনির্দিষ্ট হচ্ছে, ‘ইন্ডিয়াকে হারাতেই হবে।’ পরশু সন্ধ্যায় অতি উৎসাহী সমর্থকদের হাত থেকে বাঁচতে তামিমকে শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তারক্ষীদের সাহায্য নিতে হলো।
একটু আগেই হোটেল লবিতে যুবরাজ সিংয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তামিমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুবরাজ বলেছেন, ‘খুব তো মারছ, আমাকে একটু শিখিয়ে দাও না।’ তামিম মৃদু হেসে বলেছেন, ‘তোমাকে আমি কী শেখাব!’ যুবরাজের ব্যাটিং তামিমের খুব পছন্দ। যুবরাজ ব্যাটিং করছেন দেখলেই টেলিভিশনের সামনে বসে যান। ক্যানসার জয় করে ফেরা যুবরাজের জন্য আজকের ম্যাচটি আবার বিশেষ একটা উপলক্ষ। এটি তাঁর ৩০০তম ওয়ানডে।
বিশেষ উপলক্ষ ভারতীয় দলে এই একজনের জন্যই। বাকিদের কাছে এই ম্যাচ ‘নতুন’ কিছু নয়। সেমিফাইনাল কি আর কম খেলেছে এই দল! বাংলাদেশের সবার জন্যই এ এক নতুন মঞ্চ। সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফিকে যা বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হলো।
এক ভারতীয় সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘এটাই কি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ম্যাচ?’
মাশরাফি হেসে জবাব দিলেন, ‘২০১৫ বিশ্বকাপের ম্যাচটার আগেও এই প্রশ্ন শুনেছি।’
২০১৫ বিশ্বকাপের ম্যাচটা মানে মেলবোর্নে মহা বিতর্কিত ওই কোয়ার্টার ফাইনাল। যেটির কথা অবধারিতভাবে দুই অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলনেই উঠল। ‘ওটা ২৪ মাস আগের কথা, এরপর দুই দল আরও অনেক ম্যাচ খেলেছে’ বলে বিরাট কোহলি যেটিকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিলেন। মাশরাফিকে প্রশ্নটা হলো ‘প্রতিশোধ’ লাইনে। কোহলির উত্তরটাও তাঁকে জানিয়ে দেওয়ায় তিনি একটা তৈরি উত্তরই পেয়ে গেলেন।
ওই ম্যাচের পর দুই দল আসলেই বেশ কয়েকবার খেলেছে। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি…তবে বিশ্বমঞ্চে তো মেলবোর্নের পর এবারই প্রথম। যে ম্যাচের অনেক ছবি এখনো বাংলাদেশের মানুষের চোখে ভাসে। ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে জিওফ হার্স্টের শট বারে লেগে মাটিতে পড়ার পর গোললাইন পেরিয়েছিল কি না, এই তর্কের মতো রোহিত শর্মাকে করা রুবেলের বলটি আসলেই নো বল ছিল কি ছিল না, এটিরও কোনো মীমাংসা হয়নি। ওই ম্যাচেরই আরেকটি বিখ্যাত ছবি হয়ে আছে কোহলিকে আউট করার পর রুবেলের বুনো উদ্যাপন।
ক্রিকেট মাঠের কিছু কিছু দৃশ্য চিরকালীন ফ্রেমে ঢুকে যায়। যেমন রুবেলের ওই উদ্যাপন। সেদিনই এক প্রবাসী ভারতীয় জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘বাংলাদেশের ওই বোলারটার নাম যেন কী, কোহলির সঙ্গে যাঁর বিরাট গন্ডগোল!’ কোহলিকে আউট করতে পারলে এবারও কি অমন কিছু করার কথা ভেবে রেখেছেন? পরশু সন্ধ্যায় হোটেল লবিতে প্রশ্নটা শুনে রুবেল লাজুক হাসি দিলেন, ‘যখন হবে, তখন দেখা যাবে। ওটাও তো আগে ভেবে রাখা ছিল না।’
যেটি দুই দলই ভেবে রেখেছে, তা হলো এখানে আগে ব্যাটিং করলে প্রচুর রান করতে হবে। উইকেট রানে ভরা। এই মাঠেই প্রস্তুতি ম্যাচে ৩৪১ রান করার পরও হেরেছে বাংলাদেশ। সেই ম্যাচটি মাঠের এক পাশের উইকেটে হয়েছিল সত্যি, এক পাশের বাউন্ডারিও ছিল খুবই ছোট। তবে ফাহিম আশরাফ নামে তখন অচেনা পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান সেটির সুযোগ নেননি। যেদিকে বাউন্ডারি বড়, সেদিকেই ইচ্ছামতো মেরেছেন। এটা মারারই উইকেট।
ঐতিহাসিক এই ম্যাচে একাদশ কী হবে, তা নিয়ে বাংলাদেশ দলে খুব একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে বলে মনে হলো না। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আগের ম্যাচে দুর্দান্ত ওই পারফরম্যান্সের পর সেই দলটি তো আরেকটি ম্যাচ দাবি করেই।
এই এজবাস্টনে আঠারো বছর আগের এক সেমিফাইনাল ক্রিকেট ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার সেই ‘টাই’! শেষ দৃশ্যটা এমনই চিরকালীন ছবি হয়ে আছে যে, প্রেসবক্সে বসে মাঠের মাঝখানে তাকালেই চোখে ভেসে উঠছে ল্যান্স ক্লুজনারের পাগুলে ওই দৌড়। আজ একই মাঠে আরেকটি সেমিফাইনাল কী নিয়ে অপেক্ষা করছে, কে জানে! কাগজ-কলমের শক্তিতে ভারত অবশ্যই ফেবারিট। তবে কার্ডিফে প্রথম সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডও কি তা-ই ছিল না! এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফির থিম সংই যে এসব ফেবারিট-তত্ত্বকে অসার প্রমাণ করা! ইংল্যান্ড ২১১ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার পর হার্শা ভোগলে পরিচিত বাংলাদেশি সাংবাদিককে হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাহলে পাকিস্তান-বাংলাদেশ ফাইনাল!’
মজা করেই বলা। কিন্তু হয়েও তো যেতে পারে। ক্রিকেট বড় মজার খেলা। আর এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফি তো আরও মজার!