তার দাদার দাদা যে গ্রামে বিয়ে করেছিলেন, সরাসরি সেই গ্রামে যাওয়ার রাস্তা ছিল না। সেই গ্রামে গিয়ে বিয়ে করার জন্যে ১৮ মাইল সোজা রাস্তা তৈরি করেছিলেন। ১৮৪০ সালে আজমিরিগঞ্জ বাজার বিক্রি করে ছেলের খতনায় খরচ করেছিলেন ১২ হাজার টাকা। হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামের জমিদার পরিবারের কথা বলছি। এই জমিদার পরিবারের সন্তান স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বানিয়াচং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রাম। ফজলে হাসান আবেদের গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়া, আফ্রিকার ১৩ কোটি দরিদ্র মানুষের জন্যে কাজ করছে ব্র্যাক। দরিদ্র মানুষের জন্যে কিছু করার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুনের কাছ থেকে। এছাড়া তার জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন চাচা সায়ীদুল হাসান। একাত্তরে আর পি সাহাকে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে চাচা সায়ীদুল হাসান ধরা পড়েন পাক বাহিনীর হাতে। ধারণা করা হয় পাক বাহিনী তাকে হত্যা করে। দায়িত্বশীল হওয়ার ক্ষেত্রে তার জীবনে বড় ভূমিকা রেখেছেন বাবা সিদ্দিক হাসান। এ বছর ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ’ পেয়েছেন স্যার ফজলে হোসেন আবেদ। আমেরিকার আইওয়াতে তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে গত ১৬ অক্টোবর। সম্মানের দিক দিয়ে এই পুরস্কার নোবেলের সমপর্যায়ের মনে করা হয়। পুরস্কার, সম্মাননা তো আছেই, সঙ্গে পেয়েছেন ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার। এর আগে বাংলাদেশে এই পুরস্কারটি পেয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পুরস্কার ফজলে হাসান আবেদের জন্যে এবারই প্রথম নয়। নোবেল ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব বড় পুরস্কার-সম্মান তিনি ইতোমধ্যে অর্জন করেছেন।
ব্র্যাক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফসল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যাত্রা শুরু করেছিল ব্র্যাক। তার আগে স্যার ফজলে হাসান আবেদ সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলা দরকার বলে মনে করছি। তিনি কথা কম বলেন। নিজের সম্পর্কে বলেন আরও কম। তিনি কাজে বিশ্বাসী মানুষ। দেশের (পাকিস্তান) প্রথম নেভাল আর্কিটেক্ট হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ইংল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়েছিলেন ১৯৫৬ সালে। বিদেশে পড়তে গেলেও ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসার। ৪ বছরের কোর্স। ২ বছর পর বুঝলেন দেশে শিপইয়ার্ড হবে না। লেখাপড়াটা দেশের জন্যে কাজে লাগাতে পারবেন না। সুতরাং নেভাল আর্কিটেক্ট হওয়ার স্বপ্ন বাদ। লন্ডনে ভর্তি হলেন কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ে। পাস করলেন ১৯৬২ সালে। ইতোমধ্যে ১৯৫৮ সালে মা মারা গেলেন। দেশে ফেরার আগ্রহ কিছুটা কমে গেল। লন্ডনে চাকরি করলেন কিছুদিন। লন্ডন থেকে কানাডা গিয়ে চাকরি নিলেন। তারপর নিউইয়র্কে চাকরি করতে থাকলেন। এক দেশ থেকে আরেক দেশ ঘুরছেন, চাকরি করছেন।বিদেশে আর ভালো লাগল না। দেশে ফিরলেন ১৯৬৮ সালে। দেশে আন্দোলন চলছে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের ঘূর্ণিঝড়। দেশ টালমাটাল। ফজলে হাসান আবেদ তখন ‘শেল ‘ অয়েল কোম্পানির হেড অব ফাইনান্স। বেতন চার হাজার একশ টাকা।
ঘূর্ণিঝড়ের পর কাজ করতে গেলেন মনপুরায়। তার চার মাস পর শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। সিদ্ধান্ত নিলেন ‘শেল’ এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করবেন। ঢাকা থেকে করাচি, করাচি থেকে ইসলামাবাদ গেলেন। সেখানে গিয়ে আইএসআই’র হাতে ধরা পড়লেন। ছাড়া পেয়ে পেশোয়ার-খাইবার গিরিপথ হয়ে কাবুল, কাবুল থেকে লন্ডনে চলে গেলেন ১৯৭১ সালের মে মাসে। ইউরোপজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ শুরু করলেন আরও অনেকে মিলে।
দেশে ফিরে এলেন ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি। সিলেটের যুদ্ধবিধ্বস্ত হিন্দু অধ্যুষিত শাল্লা অঞ্চলে কাজ শুরু করলেন। ইংল্যান্ডে কাজ করছিলেন ‘হেলপ বাংলাদেশ’ ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ সংগঠনের ব্যানারে। দেশের মানুষের জন্যে প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলেটেশন অ্যাসিসটেন্স কমিটি’ সংক্ষেপে ব্র্যাক। লন্ডনের নিজের ফ্ল্যাট বিক্রির ৬ হাজার ৮০০ পাউন্ড এবং বন্ধু ব্যারিস্টার ডিকারুল ইসলাম চৌধুরীর ২৫ হাজার ভারতীয় রুপি দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ব্র্যাকের যাত্রা শুরু। ‘১৯৭১ সালের মার্চ মাসে প্রথম যেদিন শাল্লায় গেলাম, সেদিনকার কঠিন পরিস্থিতির কথা আজও মনে পড়ে আমার। থাকার জায়গা নেই। কোথায় ঘুমাব জানি না। বাজারের একটি দোকানের মাচার উপর শুতে হলো। রাতে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি হলো।মাচায় পানি পড়ল সারারাত। ঘুমাতে পারলাম না।’ স্যার ফজলে হাসান আবেদ আজও মনে করেন এই স্মৃতি।
জমিদার পরিবারের সন্তান, নিজের বড় চাকরি। বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়ার সুযোগ। ফজলে হাসান আবেদ সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজে কোনো অর্থ সম্পদের মালিক হবেন না। সারা জীবন সেই সিদ্ধান্তেই অনড় থেকেছেন। কখনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি। তার নিজের সম্পদ নেই। যে বাড়িতে তিনি থাকেন, তা নিজের নয়- মালিকানা ব্র্যাকের। তার মৃত্যুর পর সন্তানরা এ বাড়ির বা তার গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের উত্তরাধিকার হবেন না। সবকিছু ব্র্যাকের।
ব্র্যাকে কাজ করতে গিয়েই বুঝেছিলেন, অর্থ সম্পদের প্রথাগত পথ থেকে তিনি সরে এসেছেন। সন্তানদের জন্যে অর্থ-সম্পদ না রেখে তাদের শিক্ষা দিয়ে যোগ্য করে রেখে যাওয়ার নীতি নিয়ে পথ চলেছেন। বাংলাদেশকে নিয়ে অসম্ভব আশাবাদী মানুষ ফজলে হাসান আবেদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে রয়েছে তার গভীর পর্যবেক্ষণ। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদকে যদি অবহেলা করা না হতো, তাকে যদি সুযোগ দেওয়া হতো, আমার ধারণা বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত।… অত্যন্ত বিচক্ষণ-যোগ্য-দক্ষ মানুষ ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ায় দেশ, বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগ ভয়ঙ্কর ক্ষতির শিকার হয়েছে।’
নিজের অর্থে গড়ে তোলা সেই ছোট্ট প্রতিষ্ঠান ‘ব্র্যাক’ আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এনজিও। ফজলে হাসান আবেদ সম্মানিত সমগ্র পৃথিবীতে। তার মধ্য দিয়ে সম্মানিত বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ।
Courtesy : গোলাম মোর্তোজা (সম্পাদক, সাপ্তাহিক ‘ব্র্যাক ও ফজলে হাসান আবেদ’ বইয়ের লেখক )