সিনেমা হলেই যে সব সিনেমা অবাস্তব হবে এমন নয়। প্রতিবছর পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া নানা কাহিনী এর উপর ভিত্তি করেও অনেক সিনেমা তৈরী হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন থেকে শুরু করে মোম্বাই এর সন্ত্রাসী হামলা পর্যন্ত নানা কাহিনী নিয়েই তৈরী হয়েছে নানা চলচিত্র। তবে শুধু ক্রাইমের উপরেই যে মুভিগুলো নির্মিত হয় সেটা নয়, বিশ্বকে দোলা দিয়ে গিয়েছে এমন কাহিনী গুলোকেই বেছে নেন পরিচালকেরা এত উপর নির্মিত হয় মুভি। অনেকের জীবনের জয়গাধা গল্পের যেমন তাঁরা স্যালিলোজে বন্ধি করে তেমন কোন কুখ্যাত মানুষের জীবনের কুকীর্তির কথাও তুলে ধরেন পরিচালকেরা।
আজ আমি এমনই কিছু সেরা আমার দেখা বাস্তব কাহিনী নির্ভর চলচিত্রের কথা তুলে ধরব।একই ঘটনা নিয়ে একাধিক ছবিও আছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার ঘটনার আগে বা পরের কাহিনী নিয়েও ছবি হয়। এরকম অনেক বিখ্যাত ছবি আছে। এ ধরণের ছবিই আমাকে বেশি টানে। সত্য ঘটনা, পলিটিক্যাল বা কর্পোরেট ক্রাইম, সংঘাত-এসব বিষয়ের ছবিগুলোই আমার বেশি পছন্দ। এরকম কয়েকটা ছবি নিয়ে এই পোস্ট।
১। রোয়ান্ডার গণহত্যা-২০০৪:
২০০৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে রোয়ান্ডায় হুটুদের হাতে মারা যায় ৮ থেকে ১০ লাখ টুটসি। জাতিগত এই দাঙ্গা ঘটেছিল সভ্য এই দুনিয়ার সবার চোখের সামনে, জাতিসংঘকেও দায়ী করা হয় এজন্য।
১৯৯৪ সালে ১১ এপ্রিল রোয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট খুন হলে শুরু হয় গণহত্যা। হুতুরা সংখ্যাগরিষ্ট। তাদের হাতে মারা যায় টুটসিরা। জাতিসংঘ বাহিনী তখন ছিল রোয়ান্ডায় মতা ভাগাভাগি পর্যবেনে। গণহত্যা শুরু হলে স্কুলে ক্যাস্প করে জাতিসংঘ মিশন। একরাতে এখানে আশ্রয় নেয় আড়াই হাজার টুটসি। বাইরে তখন চলছে গণহত্যা। একসময় জাতিসংঘ বাহিনীও চলে যায়। ফলে গণহত্যা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
এই ঘটনা নিয়ে দুটি ছবি আছে। দুটোই বিখ্যাত। ছবি দুটো দেখাই বিশাল অভিজ্ঞতা।
হোটেল রোয়ান্ডা-
নতুন কিছু বলার নাই ছবিটা নিয়ে। অনেকেরই পছন্দের তালিকায় আছে এইটা। রোয়ান্ডার গণহত্যা নিয়ে সেরা ছবি হোটেল রোয়ান্ডা। যাকে বলে আফ্রিকান সিন্ডার্স লিস্ট। গণহত্যা নিয়ে অন্যতম সেরা ছবি বলা হয় হোটেল রোয়ান্ডাকে। আবার ছবিটা নিয়ে সমালোচনাও আছে। যেমন রোয়ান্ডায় সে সময় অবস্থানরত ইউনাইটেড ন্যাশন অ্যাসিসট্যান্স মিশন ফর রোয়ান্ডা (ইউএনএএমআইএর)-এর ভূমিকা নিয়ে। বলা হয় তারা আসলে গণহত্যা থামাতে তেমন উদ্যোগ নেয় নাই। তাদের ভূমিকা ছবিটাতে সঠিকভাবে আসেনি।
হোটেল কর্মকর্তা পল একজন টুটসি, তার বউ হুটু। পল জীবন বাজী রেখে রা করেছিল হোটেলে আশ্রয় নেওয়া কয়েকশ টুটসিকে। এটা নিয়েই ছবি হোটেল রোয়ান্ডা। ২০০৪ এটি মুক্তি পায়।
শুটিং ডগস:
সব টুটসি হোটেলে আশ্রয় নিতে পারেনি। ফলে বাঁচতে পারেনি বেশিরভাগ টুটসি। সেটি নিয়েই শুটিং ডগস ছবিটি। ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটির আরেকটি নাম আছে, বিয়োন্ড দ্য গেটস।
হোটেল রোয়ান্ডা দেখলে শেষ পর্যন্ত একধরণের ফিলগুড অনুভূতি হলেও এটি দেখে হয় না। কিভাবে গণহত্যা হয়েছে এবং জাতিসংঘের কি ভূমিকা ছিল তা অনেক বেশি পরিস্কার ভাবে এসেছে এই ছবিতে। দুর্বলচিত্তদের এই ছবি না দেখাই ভাল।
২. মিউনিক ম্যাসাকার:
১৯৭২ সালে জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস-এর সময় অলিম্পিক ভিলেজে ব্লাক সেপ্টেম্বর নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন ইসরাইলি খেলোয়ারদের জিম্মি করে। এই ব্লাক সেপ্টেম্বর ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। তাদের দাবি ছিল ইসরাইলি কারাগারের আটক ২৩৪ জনের মুক্তি। শেষ পর্যন্ত এই অভিযান সফল হয়নি। তারা ১১ ইসরায়লি খেলোয়ার ও কোচকে হত্যা করে। ৮জন ব্লাক সেপ্টেম্বর সদস্যের মধ্যে ৫ জন পুলিশের গুলীতে মারা যায়। বাকি তিনজনকে মুক্ত করতে ব্লাক সেপ্টেম্বর পরে জার্মানির লুফথানসার একটি প্লেন হাইজ্যাক করে এবং মুক্ত করে আনে। এই ঘটনা এবং পরের কাহিনী নিয়ে দুটো ছবি আছে।
২১ আওয়ার্স অ্যাট মিউনিখ
: ১৯৭৬ সালে এই ছবি মুক্তি পায়। জিম্মি ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো ঘটনা নিয়ে এই ছবি। টান টান এই ছবিটা একদমই অন্যরকম।
মিউনিখ:
২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবির পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ। মিউনিখ ম্যাসাকারের পরের ঘটনা নিয়ে এই ছবি। ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়লি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, পরিকল্পনা করেছিল সেটি নিয়ে এই ছবি। বলা যায় মোসাদের প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনা নিয়ে এই ছবি।
৩. জন এফ কেনেডি হত্যাকান্ড:
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি আততায়ীর গুলিতে মারা যায় ১৯৬৮ সালে। রহস্যময় এই ঘটনা নিয়ে দুটি ছবি হয়েছে।
ববি:
এটি মুক্তি পায় ২০০৬ সালে। কেনেডির হত্যাকান্ডের সময় আশে পাশে থাকা কিছু মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়ে এই ছবি। ছবিতে হত্যাকান্ডের বেশ কিছু প্রকৃত ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে। এন্টনি হপকিন্স, ডেমি মুর, হিদার গ্রাহাম, হেলেন হান্টসহ অনেক বিখ্যাতরা অভিনয় করেছেন ছবিটিতে।
জেএফকে:
অলিভার স্টোনের বিতর্র্কিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৯১ সালে। কেভিন কষ্টনার এর মূল অভিনেতা। নিউ অর্লিন্স-এর একজন আইনজীবী কষ্টনার তদন্ত শুরু করে কেনেডি হত্যাকান্ডের। বেশকিছু প্রমান হাজির করে এবং কারা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত তাও প্রকাশ করে। এ নিয়ে সে সময় মহা বিতর্ক হয়েছিল। লম্বা এই ছবিটা টানা দেখতে একটু কষ্ট হয় না।
৪. নিক্সন ও ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি:
নির্বাচন সংক্রান্ত গোপন তথ্য জানতে ডেমোক্রাটদের অফিসে গোপনে আড়িপাতা যন্ত্র বসাতে যেয়ে ধরা পরে ৫জন। পরে জানা যায় এরা প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কর্মকর্তা। এর ফলে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয় নিক্সনকে। এখনো যে কোনো রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি ঘটলে তার নাম দেওয়া হয় ওয়াটারগেট। ডেমোক্রেটদের অফিস ছিল ওয়টারগেট কমপ্লেক্সে। এনিয়ে তিটি ছবি আছে।
নিক্সন:
আবার অলিভার স্টোন। আর নিক্সন চরিত্রে এন্টনি হপকিন্স। ১৯৯৫ সালে এটি মুক্তি পায়। নিক্সনের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে এই ছবি। স্বাভাবিকভাবে বড় অংশ জুড়ে আছে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ও পদত্যাগের ঘটনা।
অল দি প্রেসিডেন্টস ম্যান:
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিল দুই সাংবাদিক। ওয়াশিংটন পোস্টের বব উডওয়ার্ড এবং পল বার্নস্টেইন। প্রতিবেদন তৈরির পুরো ঘটনা এবং এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে পুরো ছবি। তাদের সংবাদের উৎস ছিল ডিপ থ্রোট নামের একজন গোপন ব্যক্তি। অসাধারণ একটা ছবি। অ্যালান জে পাকুলার এই ছবি মুক্তি পায় ১৯৭৬ সালে। অভিনয়ে রবার্ট রেডফোর্ড এবং ডাস্টিন হফম্যান।
ফ্রস্ট/নিক্সন:
পদত্যাগ করে এক প্রকার নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন নিক্সন। মার্কিনীদের ঘৃণার পাত্র সে। পদত্যাগ করলেও মুখ খোলেননি নিক্সন। ফ্রস্ট একজন অখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক। মোটা অর্থের বিনিময়ে সাাৎকার দিতে রাজী হয় নিক্সন। সেই সাাৎকার নিয়ে ছবি। অসাধারণ এক ছবি, অসাধারণ অভিনয়ের ছবি। ২০০৮ সালে এটি মুক্তি পায়, রন হাওয়ার্ড এর পরিচালক।
৫. ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার:
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আল কায়েদার হামলার ঘটনা সবার জানা। সেই ফুটেজ চাইলে সবসময় দেখা যায়। মার্কিনীদের গর্ব চূর্ন করে দিয়েছিল এই হামলা। এর ফলাফল অবশ্য শেষ পর্যন্ত ভাল হয়নি। এই ঘটনা নিয়েও দুটো ছবি আছে।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার:
আবার অলিভার স্টোন, ২০০৬ সালে মুক্তি পায়। এটি মূলত উদ্ধার অভিযানের পর উদ্ধারকারীদের বীরত্বের ছবি। অভিনয়ে নিকোলাস কেজ। দুই পোর্ট অথরিটি পুলিশ কর্মকর্তা তৎপরতা, বীরত্ব আর উদ্ধার অভিযানের ছবি। ঠিক হামলার পরের ঘটনা এর মূল বিষয়।
ইউনাইটেড ৯৩:
ছবি হিসেবে এটিই বেশি ভাল। ইউনাইটেড ৯৩-এই ফাইটিও হাইজ্যাক হয়। উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত হোয়াইট হল বা হোয়াইট হাউজে বিস্ফোরন। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি যাত্রীদের বীরত্ব ও ত্যাগের জন্য। ২০০৬ সালে এটি মুক্তি পায়। যাত্রীদের অভিজ্ঞতা, তাদের স্বজনদের আহাজারি। সবমিলিয়ে খুবই ভাল একটা ছবি।