বাহুবলির রহস্য : সুমন সাহা

0

বাহুবলির স্বপ্ন রাজমৌলির মাথায় আসে যখন তার বানানো তামিল ছবি মাগাধীরা রিলিজ পায়। মাত্র ৩৫ কোটি রুপির মাগাধীরা খুব সহজেই আয় করে ফেলে প্রায় ১৫০ কোটি রুপি। বিশেষজ্ঞরা বলেন যদি সিনেমাটা আরও কিছু ভাষায় রিলিজ করা যেতো তবে সহজেই সিনেমাটি ৩০০ কোটি রুপির কাছাকাছি ব্যবসা করতে পারত।

ভারতবর্ষের মানুষের সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পের তালিকায় সবচেয়ে এগিয়েই আছে রামায়ণ, মহাভারত। এসব গল্প নিয়ে বানানো সিরিয়ালও সারাবিশ্বে ভালো ব্যবসা করেছে, এমনকি বাংলাদেশেও সিরিজ দুইটি অত্যাধিক জনপ্রিয়তা পায়। আর আমাদের আদিপুরুষেরা তো রাজতন্ত্রের অধীনেই ছিল সেদিক থেকে একরকম রাজতন্ত্রের গল্পের উপর এই উপমহাদেশের মানুষের আলাদা একটা টান আগে থেকে আছে। একজন যোগ্য, সৎ, ক্ষমতাশালী ও প্রজাপরায়ণ একজন রাজার স্বপ্ন এবিশ্বের প্রতিটা পরিবারই দেখে। এসব কিছু গত কয়েক দশকের সিনেমা পাড়া ঘুরে আসলে বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। এরপর এক বীরের মৃত্যু মানুষকে সব সময়ই ব্যাথিত করে, আর সেটা যদি হয় তার সবচেয়ে কাছের কোন মানুষের কাছ থেকে তবে সেই কারণের খোঁজে তো মানুষ থাকবেনই। তবে মানুষ খুব দ্রুতই নিজের ইতিহাসই ভুলে যায় সেখানে সিনেমার ইতিহাস মনে রাখা তো দূরের কথা তাই পরিচালক দর্শক ধরে রাখতে খুব বেশি সময় ও নিতে চান নাই, এটা সফলতার আরেকটা বড় কারণ।

সুতরাং মাগাধীরার পর এমনই এক রাজতন্ত্রের গল্প নিয়ে আবার জুটি বাধার সিদ্ধান্ত নেন পরিচালক রাজমৌলি ও গল্পকার বিজেন্দ্র প্রসাদ। বিজেন্দ্র প্রসাদ এর গল্প লেখার হাত অসাধারন, সেটা তার একেরপর এক সুপারহিট গল্প জন্ম দেওয়া দেখলেই বোঝা যায়। তারপরও তিনি আরও সূক্ষ্ম ভাবে পর্যালোচনা করতে শুরু করেন ভারতবর্ষের রাজতন্ত্রের গল্পগুলোকে, তিনি অনেক কিছুরই মহাভারতকে অনুকরণে লিখেছেন। রাজমৌলিও গল্প হাতে পাওয়া মাত্রই নেমে পড়েন বাজেট খুঁজতে, যার সিনেমা ২০০৯ সালেই স্বল্প প্রচারণায় ৩০০ কোটির মুখ দেখতে বসেছিল তার ২৫০ কোটি টাকা বাজেট পাওয়া খুব বেশি কষ্টের ছিল না তবে কোন প্রযোজকেরাই মাগাধীরার প্রচারণা ব্যার্থতাকে আবার পুনরায় জন্ম দিতে রাজি হলেন না।

রাজমৌলি তখন নিশ্চিত করার চেষ্টা করলেন যে ইনভেস্টটা সেফ। বাহুবলীর সফলতার মূলে রয়েছে মার্কেটিং স্ট্রাটেজি। তারা বুঝতে পেরেছিলেন ২৫০ কোটি টাকা তুলতে হলে সবার আগে সিনেমাটি সবার আগে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। এরজন্য পরিচালক মনে করেছিলেন বেশকিছু বলিউডের নায়ক নায়িকা দিয়ে সিনেমা সাজালে এমনিই প্রচারণা পেয়ে যাবে। কিন্তু কোন বলিউডের তারকাই সিনেমায় এমন আগ্রহী ছিলেন না বা সময় ছিল না। তিনি হতাশ না হয়ে টলিউডের প্রভাস আর তামান্নাকেই বেঁছে নেন। প্রভাস তামিলে বেশ জনপ্রিয় নায়ক হলেও হলিউডে তেমন পরিচিত নন কিন্তু তামান্না ও রানা বেশ জনপ্রিয় হলিউডে, এটা নিয়েই কোন রকম সন্তুষ্ট থাকতে হয় রাজমৌলিকে। এরপর সিনেমাটাকে সবার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য তামিলের পাশাপাশি হিন্দি, ফার্সি ও জার্মান ভাষায় বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। এখানেও আছে ডাটা এনালাইসি। ভারতের তামিল এই রাজতন্ত্রের ধাঁচের সিনেমা বেশি জনপ্রিয় ফ্রান্স আর জার্মানীতেই।

সমালোচনাটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মার্কেটিং কৌশল দিয়ে শেষ করা যাক। ২০১৫ সালে রিলিজ হবে এমন একটা সিনেমার ফেসবুক আর ইউটিউব প্রচারণা শুরু হয় রিলেজের ২ বছর আগে থেকেই। একের পড় এক মুক্তি পেতে থাকে সিনেমাটির মেকিং ভিডিও। একে তো এত বড়া বাজেটের সিনেমা কেমন বানানো হচ্ছে সেটার প্রতি আকর্ষন আগে থেকেই মানুষের ছিল এরপর রাজমৌলি কিছুদিন পর পর সিনেমার আপডেট জানিয়ে দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখার পুরো চেষ্টাই করে গিয়েছেন। ২০১৫ সালে সিনেমা রিলিজের আগে তিনি বড় দুইটি ব্রহ্মা অস্ত্র মারেন যা আগে কখনই বলিউড ইতিহাসে হয় নাই। তিনি সকলের মনোযোগ আকর্ষন করার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় সিনেমার পোস্টার উন্মোচন করেন কচিতে। যা একবারেই সকল টিভি চ্যানেলের প্রধান শিরোনামে পরিণত হয়। আর দ্বিতীয় ব্রহ্মা অস্ত্র ছিল WhatsApp, যাকে এতবড় মার্কেটিং প্যালেস হিসাবে আগে কোন পরিচালক মনে করেন নাই। ডাটা বলে ভারতে ফেসবুকের চেয়ে জনপ্রিয় টুইটার, আর ম্যাসেঞ্জারের চেয়ে জনপ্রিয় WhatsApp. সেজন্য সবচেয়ে বড় প্রচারণাটাও করা হয় WhatsApp এই। এরপর সবচেয়ে বড় ঝুকি ছিল – কতগুলো হল এর কতগুলো স্ক্রিন পাচ্ছে সিনেমাটি। এজন্য তারা সাহায্যের জন্য ছুটে যান ধর্ম প্রডাকশনের কাছে, একমাত্র তারাই পারতেন ভারতের ও বহির্বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হলের স্ক্রিন দখলের।

এরপর আপনারই বলুন এত সুন্দর নিখুঁত প্ল্যান দেখে কোন বিনিয়োগকারী অর্থ দিতে না চাইবেন? এখান থেকে আমাদের পরিচালক, অভিনেতা, মার্কেটার ও বিনিয়োগকারীদের অনেককিছুই শেখার – জানার আছে। নয়ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজেটের সিনেমা পরবাসীর মত অনেক সিনেমাই প্ল্যানের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে।

কারো কোন প্রশ্ন বা মতামত থাকলে জানাতে পারেন।

সামনেই The Game Of Thrones এর সফলতা নিয়ে বিশ্লেষণ হবে 😀

[ বি দ্রঃ ২০১৩ সালে এনিমেশন মুভি ” মহাভারত ” থেকে অনেক শিক্ষাই নিয়েছিলেন রাজমৌলি। কারণ এত ভালো কাহিনী নিয়েও ৫০ কোটি রুপীর মুভিটি আয় করে মাত্র দেড় কোটি টাকা। অমিতাভ বাচ্চন, ওজন দেবগানের মত অনেক নামকরা অভিনেতা নিয়েও ভরাডুবির অনেক গুলো কারণ ছিল। যেমন – এতবড় কাহিনীকে মাত্র দেড় ঘণ্টায় রূপান্তর করার ভুলচেষ্টা, বাচ্চাদের জন্য বানালেও গল্পটা শিশুতোষ ছিল না, নিন্ম কোয়ালিটির সম্পাদনা ও ভিএফএক্স, প্রচারণার অনেক অনেক ভুল সহ অনেক কিছুই। যার ব্যার্থতা রাজমৌলিকে অনেকটাই সতর্ক করে দিয়েছিল সিনেমাটাকে ২ পার্টে ভাগ করতে, তামান্নাকে দিয়ে কিছু আবেদনময়ী শর্ট করে কিছু তরুণ দর্শকদের দৃষ্টি আটকাতে, এমন কিছু ভিএফএক্স এর কাজ আনতে যা আগে হলিউডেও দেখা যায় নাই। ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *