বাংলাদেশের অনেক প্রতিভাবান, কর্মনিষ্ঠ মানুষ আন্তজার্তিক অংগনে নিজেকে এবং নিজের দেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা নিজের ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি দেশের তরুণ সমাজের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এমন-ই একজন মানুষের জীবনের গল্প নিয়ে আমাদের আজকের এই লেখা।
তিনি হলেন ‘শাহিনুর আলম জনি‘। বর্তমানে তিনি ‘এরিকসন'( Ericsson), আয়ারল্যান্ড এ ‘সিনিয়র ক্লাউড সল্যুশন ম্যানেজার’ হিসেবে কর্মরত, জবের পাশাপাশি বিশ্বের টপ ইউনিভার্সিটি হার্ডভ্যার্ড (HBS), MIT,স্ট্যানফোর্ড এ লেখাপড়া করেছেন কখনো বিসনেস আবার কখনো লেটেস্ট টেকনোলজি (Artificial Intelligence, ML, NLP, Big Data, IOT, Cloud Computing, Robotics, 5G and so on) নিয়ে এবং ‘ইয়ুথ কার্নিভাল’ নামক একটি সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। একটি মজার বিষয় হল তিনি দেশের বাইরে থাকলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্যা শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি খুব ভাল ভাবে পরিচিত। সবাই তাঁকে ‘জনি ভাই’ বলেই চেনে। ? প্রশ্ন হল দেশের বাইরে অবস্থান করা সত্বেও এটা কিভাবে সম্ভব! অবশ্যই সম্ভব। একটু ধৈর্য ধরে লেখাটা পড়তে থাকুন উত্তর পেয়ে যাবেন। ?
শাহিনুর আলম জনি বগুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বগুড়ার স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ১৯৯৭ সালে তৎকালীন বি আই টি, খুলনা অর্থাৎ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়( কুয়েট) এর তড়িৎ কৌশল বিভাগে(EEE) ভর্তি হন। ২০০২ সালে স্নাতক শেষ করেন।
এরপর গ্রাজুয়েশন শেষে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে “কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার” হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ২০০৫ সালে ZTE, BD কোম্পানিতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। এরপর Huway, BD তে কিছুদিন চাকুরীর পর তিনি Ericsson, BD তে যোগদান করেন। এরপর এরিকসনের বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজের জন্য দুবাই এবং নাইজেরিয়া গমন করেন।
২০১০ সালে নাইজেরিয়ায় অবস্থানরত অবস্থায় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারনে চাকুরী হারান। উল্লেখ্য, আমরা জানি ২০০৯- ২০১০ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ফলে পুরো বিশ্ব জুড়ে জব সেক্টরে সংকটাবস্থা শুরু হয়। এরপর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ২০১০ সালে ভারতের Airtel এর 3G প্রজেক্টের জন্য তিনি মনোনীত হলেও সেসময় দুর্ভাগ্য ক্রমে ভিসা পাননি। স্বাভাবিক ভাবেই খুব খারাপ একটা সময় তিনি পার করছিলেন, কিন্তু তিনি ভেংগে পড়েন নি। থেমে থাকেন নি। অলসভাবে বসে থেকে সময় নষ্ট না করে নিজেকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, আরো বিকশিত করার জন্য CCNP এবং PMP কোর্স করেন। তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক প্রচুর পড়াশুনা করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি গুলোতে আবেদন করতে থাকেন।
এক পর্যায়ে ভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়। ২০১১ সালে তিনি Ericsson, China তে যোগদান করার সুযোগ পান এবং সবচেয়ে বড় বিষয় তিনিই প্রথম বাংলাদেশী যিনি Ericsson China তে কাজ করার সুযোগ পান। চীনে তিনি ২০১১ এবং ২০১৩ তে দুইবার ‘Best Employee’ হিসেবে আখ্যায়িত হন। আসলে কথায় আছে: ‘পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না’। আজ হোক কাল হোক সফলতা আসবেই, ঠিক যেমনটি পেয়েছিলেন শাহিনুর আলম জনি।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। শুধুই সামনের দিকে এগিয়ে চলা। প্রজেক্টের কাজে তিনি ফ্রান্সে চলে যান। এরপর চাকুরীর বিভিন্ন ধাপে পর্যায়ক্রমে গ্রীস, ইন্দোনেশিয়া, স্পেন, রাশিয়া,পোল্যান্ড, জার্মানি, বাহরাইনে প্রজেক্ট করেছেন।
২০১৩ সালে নিজেকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে তল্পাতল্পি সহ তিনি ইউরোপে পাড়ি জমান এবং এরিকশন, আয়ারল্যান্ডে যোগদানের মাধ্যমে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেন। এরিকশন, আয়ারল্যান্ডের হয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজে বিভিন্ন সময় তিনি আমেরিকা, সুইডেন, জার্মানি, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্য, সৌদি আরব, কানাডা, তুরস্ক, ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, ইন্ডিয়া, গুয়েতমালা,মেক্সিকো, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রেলিয়ায় প্রজেক্ট করেছেন।
শাহিনুর আলমের সাথে সাক্ষাতকার :
*আপনি এখন তথ্য প্রযুক্তির কোন কোন কোন ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করছেন?
– আমি এখন IOT, বিগডাটা, ক্লাউড কম্পিউটিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করছি। 5-G নিয়েও আমরা প্রজেক্ট করছি।
* একজন তরুণের আন্তজার্তিক অংগনে ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে কী করনীয় হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
– বর্তমান চাকুরীর বাজার প্রতিযোগিতাময়। তাই নিজেকে যত বেশি পারা যায় ডেভেলপ করতে হবে। এজন্য একজন তরুণের অবশ্যই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কোয়ালিটি অর্জন করতে হবে।
(1) Passionate
(2) Hardworking with Smartness
(3) Continuous Learner
এ পয়েন্ট টা একটু ব্যাখা করি।আমরা যারা প্রকৌশলী তাদেরকে অবশ্যই নতুন নতুন বিষয়গুলোকে নিয়ে পড়া শুনা করতে হবে। আমাদের অনেকের মধ্যেই একটা সীমাবদ্ধতা কাজ করে- আমরা জব পেয়ে গেলে আর পড়াশুনা করি না। যার কারনে আমরা প্রতিযোগতাময় বিশ্বে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারি না। So, Obviously continuous study is a must in this regard.
(4) Effective Communication Skill.
মূলত এই বেসিক কোয়ালিটি গুলো অর্জনের মাধ্যমে একজন তরুণ যে কোন ফিল্ডে ভাল করতে পারে।
* কোন বিষয়টা আপনাকে ‘ইয়ুথ কার্নিভাল’ প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত
করেছে?
– আসলে আমরা দেশের ভেতরে থেকে যতটা মনে করি যে বিশ্বে আমাদের দেশের খুব ভাল পরিচিতি আছে আসলে তা না। এখন কিছুটা বেড়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বদলে। আমাকে অনেক যায়গায় অনেক ফরেনার জিজ্ঞেস করত – Are you Indian? আমি উত্তর দিতাম -No, I am Bangladeshi. তখন তারা নামটা শুনে অবাক হয়ে বলত Bangladesh!! তখন আমাকে বাধ্য হয়ে বলতে হত ‘Bangladesh is a Neighboring country of India’. এভাবে নিজের দেশের পরিচয় দিতে আমার খুব খারাপ লাগত। সেই খারাপ লাগা থেকেই আন্তজার্তিক বাজারে বেশী বেশী বাংলাদেশীদের সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। কিন্তু আমাদের দেশের তরুণদের মাঝে আন্তর্জাতিক অংগনে ক্যারিয়ার গড়ার তথ্য এবং নেটওয়ার্ক এর অভাব থাকায় তা সম্ভব সম্ভব হচ্ছিল না। তাই নেটওয়ার্ক বিল্ড আপ এবং সঠিক তথ্য প্রদান , দিকনির্দেশনা দেবার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে ‘ইয়ুথ কার্নিভাল’ নামক এই কমিউনিটি গড়ে তোলা হয়েছে যেটা প্রতিবছর বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের উপর লাইভ সেশন করে। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের কোম্পানি গুলোর জবের তথ্য প্রদান করা হয়।
* আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
– আমি বিজনেস লিডার হিসেবে কাজ করতে চাই
অর্থাৎ যে কোন ডিসিশন নেবার ক্ষেত্রে আমার মতামতের মূল্যায়ন থাকবে এবং বাংলাদেশের তরুণদের ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে চাই ।
* তরুণদের নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
বাংলাদেশের তরুণরা অনেক বেশী সৃষ্টিশীল। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, নতুন কিছু করার শক্তি আমাদের দেশের তরুণদের আছে। ইতোমধ্যে অনেক তরুণ আন্তজার্তিক প্রতিযোগিতা গুলোতে ভাল করেছে। বেশ কিছু তরুণ গুগল,মাইক্রোসফট এর মত জায়ান্ট কোম্পানি গুলোতে কাজ করছে। আমি আশা করি- একদিন International job market এর বড় একটা অংশ জুড়ে আমাদের তরুণরা কাজ করবে ইনশাল্লাহ।
‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট
বিশ্বাস হৃদয়ে
হবেই হবে দেখা
দেখা হবে বিজয়ে….’
মো: দেলোয়ার জাহান সোহাগ
সভাপতি, চুয়েট ক্যারিয়ার ক্লাব
One Comment
Leave a Reply