জীবনের উত্থান-পতনে দুঃখ কিংবা সুখগুলো আড়ার হলেও স্মৃতিগুলো মনে গেঁথে থাকে আজীবন। তেমনি রোমেলু লুকাকু আজ বিশ্বের অন্যতম সেরা এক ফুটবলারের নাম। জিতেছেন অনেক শিরোপা, আয় করেছেন অঢেল অর্থ। কিন্তু পেছনের সেই দুঃখ-কষ্টের দিনগুলো ভোলেননি। বিলাসী জীবনের মাঝেও ছোটবেলার দারিদ্রপীড়িত জীবনকে মনে রেখেছেন ম্যানইউ এবং বেলজিয়ামের তারকা ফুটবলার রোমেলু লুকাকু। রাশিয়া বিশ্বকাপে তিনি আরও একবার নিজের জাত চিনিয়েছেন।
টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরষ্কার জেতার দৌড়ে তিনি রয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ তাকে পরিচিতি এনে দিয়েছিলো অনেক আগেই কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপে লুকাকু নিজেকে বিশ্ব দরবারে আরো ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। রোমেলু লুকাকু আজ বিশ্বের সেরা এক ফুটবলারের নাম। নিজের নাম বিশ্বের দরবারে পরিচিত করার জন্য অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। রোমেলু লুকাকুর সেই অতীত এবং বর্তমান পথ নিয়ে এই আয়োজন।
শৈশব
রোমেলু লুকাকু ১৯৯৩ সালের ১৩ মে বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্পে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রজার লুকাকু ছিলেন পেশাদার ফুটবলার এবং মা অ্যাডলফিনে লুকাকু ছিলেন গৃহিনী। তিনি বেলজিয়ামের সংখ্যালঘু কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। লুকাকুর প্রথমে ফুটবলের প্রতি তেমন আগ্রহ ছিলো না।
তার বাবা-মাও চাইতেন না তাদের সন্তান ফুটবলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ হারান। কিন্তু লুকাকুর বাবা পেশাদার ফুটবলার হওয়ার কারণে তিনি ছিলেন ফুটবলের অনেক বড় ভক্ত। তিনি নিয়মিত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দেখতে দেখতেন। লুকাকু তার বাবার সাথে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দেখতে শুরু করেন। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দেখতে দেখতে ফুটবলের প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়ে যায় এবং এক সময় সেটা নেশায় পরিণত হয়ে যায়।
ফুটবল দেখার পাশাপাশি ফুটবলের ভিডিও গেমসের প্রতিও তিনি আসক্ত হয়ে পড়েন। ফুটবলে নেশা থাকলেও পড়াশোনায় খুবই ভালো ছিলেন রোমেলু লুকাকু। সে কারণে প্রথমে তার বাবা-মা তাকে ফুটবল ক্লাবে ভর্তি করে দিতে না চাইলেও ফুটবলের প্রতি লুকাকুর আসক্তি দেখে তার বাবা ‘রুপেল বুম’ নামে এক স্থানীয় ক্লাবে ভর্তি করে দেন। খুব অল্প দিনের মধ্যে তিনি তার ফুটবল প্রতিভাকে বিচ্ছুরিত করতে থাকেন।
তিনি তার ক্লাবে যুব ফুটবলারদের মধ্যে সেরা অবস্থান সৃষ্টি করেন।
সংগ্রামী পারিবারিক জীবন
রোমেলু লুকাকুর পরিবার অভিবাসী হিসেবে আফ্রিকার দেশ জায়ারে (বর্তমান কঙ্গো) থেকে বেলজিয়ামে আসেন। অভিবাসীদের মধ্যে যারা ভালো ফুটবল খেলতে পারতেন তাদের জন্য বাড়তি সুবিধা থাকতো। দারিদ্রতাকে জয় করার জন্য তার বাবা পেশাদার ফুটবলে নাম লেখান। লুকাকুর বাবার বয়স যখন ২৩ তখন তিনি পেশাদার ফুটবলে নাম লেখান। এই বয়সে পেশাদার ফুটবলে নাম লেখানো খুবই কঠিন। সেই সাথে তার ছিলো না যুব পর্যায়ে খেলার অভিজ্ঞতা। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে রজার লুকাকু ফুটবলের সাথে দারুণভাবে মানিয়ে নেন এবং ফুটবল খেলে অর্জিত আয় থেকে সংসারের সব ব্যয় মেটাতেন। তিনি বেলজিয়ামের কয়েকটি স্থানীয় ক্লাবে খেলার পাশাপাশি জায়ারের হয়ে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বও খেলেন। কিন্তু রোমেলু লুকার বয়স যখন মাত্র ৬ বছর।
তখন তার বাবার ক্যারিয়ার শেষের দিকে। তার আয় কমে যেতে থাকে। তাদের কষ্টের দিন শুরু হয়। লুকাকু বুঝতে পারেন যে তাদের কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারা একেবারে সর্বশ্রান্ত হয়ে যান। লুকাকুর মা তাদের দুই ভাইকে প্রতিদিন একই খাবার খেতে দিতেন। সেটা ছিলো দুধ আর পাউরুটি। এক সময় তার মা সেটাও দিতে পারতেন না।
তার মা সামান্য দুধের সাথে পানি মিশিয়ে খেতে দিতেন। একের পর এক দুর্যোগ নেমে আসে। দারিদ্রতা চারিদিক থেকে তাদের ঘিরে ধরে। প্রিয় ফুটবল খেলার মাধ্যম টিভি বিক্রি করে দিতে হয়। বাড়ির বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে এক নিদারুণ কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন শুরু হয় লুকাকুদের। তখন লুকাকু প্রতিজ্ঞা করেন, তিনি পেশাদার ফুটবলার হবেন। ফুটবল খেলে অর্থ আয় করে পরিবারের দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন।
তিনি ১১ বছর বয়স থেকে লিয়ার্সের যুব দলের হয়ে খেলা শুরু করেন। ফুটবল দিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে লুকাকু জীবন এবং ফুটবল দুটোকেই জয় করেছেন। দেশ এবং ক্লাব দুই জায়গাতে ফুল ফোটাচ্ছেন তিনি।
ক্লাব ক্যারিয়ার
রোমেলু লুকাকু তার ফুটবলে হাতেখড়ি নেন অ্যান্টওয়ার্পের স্থানীয় ক্লাব রুপেল বুমে। সেখানে চার বছর কাটিয়ে তিনি যোগ দেন লিয়ার্সে। লিয়ার্স ছিলো বেলজিয়ামের পেশাদার ফুটবল ক্লাব। তাদের যুবদলে খেলতে শুরু করেন লুকাকু। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত লিয়ার্সের যুবদলের হয়ে ৬৮ ম্যাচ খেলে ১২১টি গোল করেন।
লিয়ার্স প্রথম বিভাগ থেকে দ্বিতীয় নেমে গেলে তিনি সহ লিয়ার্সের ১৩ জন ফুটবলার আন্ডারলেক্ট ক্লাবে যোগ দেয়। আন্ডারলেক্টের যুব দলের হয়ে ৩ বছর খেলে লুকাকু ৯৩ ম্যাচে ১৩১টি গোল করেন। রোমেলু লুকাকু দারিদ্রের দিনগুলোতে বাবাকে কথা দিয়েছিলেন ১৬ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলে নাম লেখাবেন। তিনি ১৬ বছরে পা দেওয়ার পর ২০০৯ সালে ১৩ মে আন্ডারলেক্টের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন।
২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি আন্ডারলেক্টের হয়ে খেলেন। আন্ডারলেক্টের হয়ে দুই মৌসুম খেলে রোমেলু লুকাকু ৭৩ ম্যাচে ৩৩টি গোল করেন। এরপর তিনি আন্ডারলেক্ট থেকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব চেলসিতে যোগ দেন। চেলসিতে যোগ দিলেও চেলসি তাকে দুইবার ধারে খেলতে পাঠায়। ২০১২-১৩ মৌসুমে তিনি চেলসি থেকে ধারে খেলতে যান ওয়েস্ট ব্রমউইচে। এরপর তাকে ২০১৩-১৪ মৌসুমে আবারো ধারে পাঠানো হয় এভারটনে। এভারটনের হয়ে ধারে খেলতে গিয়ে ৩১ ম্যাচে ১৫ গোল করেন।
পরবর্তীতে তিনি চেলসি থেকে ২৮ মিলিয়ন পাউন্ডে এভারটনে যোগ দেন। এভারটনের হয়ে তিনি ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খেলেন। এভারটনে তিন মৌসুম খেলে রোমেলু লুকাকু ১১০ ম্যাচে ৫৩টি গোল করেন। গত মৌসুমে তিনি এভারটন থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেন। ঠিক কত দামে ম্যানইউ তাকে দলে ভিড়িয়েছে সেটা প্রকাশ করা হলেও বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে অনুমান করা হয় যে, তাকে দলে আনার জন্য হোসে মরিনহো ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতে হয়েছে।
ম্যানইউয়ের হয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এক মৌসুমে ৩৪টি ম্যাচ খেলে ১৬টি গোল করেছেন।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার
রোমেলু লুকাকু দেশের হয়ে অনুর্ধ্ব-১৫ দল থেকে খেলতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০৯ সালে তিনি বেলজিয়ামের অনুর্ধ্ব-২১ দলে সুযোগ পান। অনুর্ধ্ব-২১ দল থেকে ২০১০ সালে তিনি জাতীয় দলে ডাক পান। ২০১০ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচে বেলজিয়ামের হয়ে লুকাকুর অভিষেক হয়। দেশের হয়ে অভিষেকের দুই বছর পর লুকাকু নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক গোল করেন।
দেশের হয়ে লুকাকু ২০১৪ বিশ্বকাপে খেলেন এবং ১টি গোল করেন। ২০১৪ বিশ্বকাপে ১টি গোল করলেও চার বছর পর ২০১৮ বিশ্বকাপে দারুণ খেলছেন রোমেলু লুকাকু। তার সম্পর্কে এই লেখার আগ পর্যন্ত তিনি মোট চারটি গোল করেছেন। তার দল বেলজিয়াম শেষ পর্যন্ত কোথায় থামবে সেটা থেকে নিশ্চিত হওয়া যাবে তার গোল সংখ্যা।
ব্যক্তিগত জীবন
রোমেলু লুকাকু ২০১৪ সাল থেকে জুলিয়া ভ্যান্ডেনওয়েগের সাথে প্রেম করছেন। তিনি কোনো শ্বেতাঙ্গ ফর্সা রমণীর সাথে প্রেমে জড়াননি বরং ভালোবেসেছেন তার মতোই এক কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে। তারা একে অপরকে প্রচন্ড ভালোবাসেন এবং কখনোই সম্পর্ক নিয়ে লুকোচুরি করেন না। তারা বেশ কয়েক বছর ধরে একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবেসে যাচ্ছেন তাই ধারণা করা যাচ্ছে তাদের সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে।
এছাড়া রোমেলু লুকাকু তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নির্মিত ডকুমেন্টারি ‘দে স্কুল ভ্যান লুকাকু‘তে অভিনয় করেছেন। এই ডকুমেন্টারিতে তার স্কুল জীবন থেকে শুরু কর যুব দল সবকিছু তুলে ধরা হয়েছে। রোমেলু লুকাকু নিজ দেশের ভাষা ছাড়াও ডাচ, পর্তুগিজ, ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ ভাষা জানেন। এছাড়া জার্মান ভাষা বলতে না পারলেও বুঝতে পারেন।
Featured Image: thenational.ae
BY: Zahid Hasan Mithu
SOURCE: http://khela.co/football/untold-story-of-romelu-lukaku/