২০ বিস্ময় বিস্ময়কর বাফেটের

0

বিল গেটস ও তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস চলতি বছরে তঁাদের বার্ষিক চিঠি লিখেছেন ‘ওমাহার ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাকে’। দৈবক্রমে ভ্যালেন্টাইন ডেতে পাঠানো চিঠিটি ভালোবাসার চিঠি হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে। এটির পরতে পরতে রয়েছে মহান এক ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর মানবপ্রেম ও প্রজ্ঞার জয়গান গাওয়া হয়েছে চিঠিতে। সেই ভালোবাসার চিঠিতে গেটস লেখেন, তাঁর জীবনে মহান এ ব্যক্তির ইতিবাচক প্রভাব অন্য কারও চেয়ে বেশি। গেটসকে প্রভাবিত করেন যে মানুষটি, তিনি হলেন ওয়ারেন বাফেট।

বিনিয়োগদ্রষ্টা হিসেবে পূজনীয় বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা এ ধনকুবের বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনকে একবারেই দান করেছেন ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। শুধু তা-ই নয়, ৬২০ বিলিয়ন ডলারের বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের শেয়ারের ৮৫ শতাংশ জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অঢেল যাঁর সম্পদ, সেই মানবহিতৈষী মানুষটি সকালের নাশতায় এখনো ৩ দশমিক ১৭ ডলারের বেশি ব্যয় করেন না।
‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখবেন না’, ‘কখনোই লোকসান করবেন না’—বিনিয়োগের প্রথম নিয়ম এটি। আর দ্বিতীয় নিয়ম হলো ‘প্রথমটিকে অনুসরণ করা’—শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্য অনুকরণীয় এমন উদাহরণ তৈরি করে তিনি এখন জীবন্ত কিংবদন্তি। ব্যবসায়ী তারকা বলতে যা বোঝায় তিনি তাই। বিনিয়োগে সফলতার ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় হলেও কিছুটা অসফলতা রয়েছে তাঁর। আছে কিছু না পাওয়ার গল্প। হার্ভার্ডে ভর্তি হতে পারেননি। তাঁর শ্বশুর মনে করতেন, তিনি মোটেই সফল হতে পারবেন না। তবে কঠোর পরিশ্রম ও চেষ্টায় তিনি আজকের অবস্থানে পৌঁছেছেন। নিজের মুখেই একেক সময় খুলে দিয়েছেন অজানা রহস্যের সেই ঝাঁপি, বলেছেন তাঁর প্রেমে ব্যর্থতার কথাও।

ব্যবসা-বাণিজ্যের জনপ্রিয় তারকা ওয়ারেন বাফেটের অজানা বিষয়ের প্রতি আগ্রহের কমতি নেই। এই যেমন, অনেকেই হয়তো এটি শুনে আঁতকে উঠবেন স্মার্টফোনের এ চাকচিক্যের যুগেও তিনি নকিয়া ফ্লিপ ফোন ব্যবহার করেন। এ বিনিয়োগদ্রষ্টার বিস্ময়কর এমন ২০ তথ্য নিয়ে এ প্রতিবেদন।
১১ বছরের এক বালক কী করতে পারে, একটু কল্পনা করুন তো। বেশির ভাগই টি-শার্ট পরে ক্রিকেট বা ফুটবলে মেতে থাকে কিংবা ভিডিও গেম ও কার্টুনে ডুবে থাকে। আর বাফেট প্রথম শেয়ার কেনেন এ বয়সেই। ১৯৪২ সালে সিটি সার্ভিস প্রেফার্ডের শেয়ার কিনেছিলেন, প্রতিটির দাম ছিল ৩৮ ডলার।
কিশোর বয়সেই আয়ের দিকে ঝোঁক ছিল তাঁর। দৈনিক সকালে ওয়াশিংটন পোস্ট বিলি করতেন। মাসে এ থেকে আয় হতো ১৭৫ ডলার। ওই সময়ে একজন শিক্ষক এ পরিমাণ আয় করতেন। ব্যবহৃত গলফ বল, স্মারক স্ট্যাম্প, রং ওঠা গাড়িও কেনাবেচা করতেন। এভাবে ১৬ বছর বয়সেই এ কিংবদন্তি ৫৩ হাজার ডলার আয় করেছিলেন। সেই তরুণ বয়স থেকেই তিনি শুধু কৌশলী নন, কঠোর পরিশ্রমীও ছিলেন।
তাঁর বড় অসফলতার একটি হার্ভার্ডে টিকতে না পারার বিষয়টি। নেবারস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শেষে হার্ভার্ডের ব্যবসা অনুষদে ভর্তি হতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। পরে তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদে ভর্তি হন। এটা নিয়েও একটা মজার গল্প আছে। হতাশ বাফেট একদিন আবিষ্কার করেন তাঁর পছন্দের ব্যক্তিত্ব ‘ভ্যালু ইনভেস্টিংয়ের’ জনক বেন–জামিন গ্রাহাম ও ডেভিড ডল কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের শিক্ষক। তিনি তাঁদের লেখেন, ‘প্রিয় অধ্যাপক ডড, আমি ভেবেছিলাম আপনারা বেঁচে নেই। হঠাৎ দেখি আপনারা বহাল তবিয়তে শিক্ষকতা করছেন। আমি আপনাদের ওখানে আসতে চাই।’ ফিরতি চিঠিতে তাঁরা তাঁকে ডেকে নেন।

কোকাকোলা ও আইসক্রিম খেয়ে ৮৬ বছর বয়সেও তরুণ ছিমছাম থাকার রহস্যও বর্ণনা করেছেন এ বিনিয়োগ গুরু। ফরচুনকে বলেন, ছয় বছর বয়সীদের মৃত্যুহার সবচেয়ে কম। এ তথ্য উদ্ঘাটনের পর তাদের খাবার তালিকা অনুসরণ করেন তিনি। দিনে ২৭০০ ক্যালরির মধ্যে এক-চতুর্থাংশ আসে কোক থেকে। ১২ আউন্স করে দিনে পাঁচবার যা পান করেন। কখনো নাশতায় সোডার সঙ্গে এক ক্যান উটজ পটেটো খেয়ে থাকেন। কখনো এক বাটি আইসক্রিম খেয়ে দিন শুরু হয় তাঁর।

একজন বিলিয়নিয়ারের জীবনযাপন চাকচিক্য ও জৌলুশে ভরা—এমনটাই সচরাচর চোখে পড়ে। মিলিয়ন ডলারের প্রাসাদ, নিজস্ব দ্বীপ, উড়োজাহাজ ও ইয়ট—কী নেই তাদের। অথচ সাড়ে সাত হাজার কোটি ডলারের মালিক হয়েও সেই ১৯৫৮ সাল থেকে বাস করছেন একই বাড়িতে। ওমাহা হাউস নামের পাঁচ বেড ও আড়াই বাথরুমের সেই বাড়ি ওই বছর কিনেছিলেন সাড়ে ৩১ হাজার ডলারে।

শুধু বাড়ি নয়, এখনো তিনি নকিয়া ফ্লিপ ফোন ব্যবহার করছেন। সিএনএনকে মজা করে বলেছিলেন, এটি সেই ফোন, যা তাঁকে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল দিয়েছিলেন। ২০-২৫ বছর কোনো কিছু ব্যবহার না করলে তা আমি ফেলে দিই কী করে—সদাহাস্য এ ধনকুবেরের মন্তব্য।

১৯৫২ সালে প্রথম স্ত্রী সুশানকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার সময় তাঁর শ্বশুরের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, মেয়েটার কপালে সুখ জুটবে না, কেননা বাফেট শেষ পর্যন্ত ব্যর্থই হবেন।

অথচ এখন তাঁর সঙ্গে দুপুরে এক বেলা খাবার খেতে লাখ লাখ ডলার দিতেও আপত্তি নেই ভক্তদের। ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর দাতব্য তহবিল সংগ্রহে এ মধ্যাহ্নভোজের জন্য নিলাম ডাকা হয়। এখন পর্যন্ত দুই কোটি ডলার উঠেছে। একবার তো ৩৪ লাখ ডলার দিয়েছেন একজনই। ২০১৩ সালের শুরুতে বাফেটের সম্পদ ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। বছর শেষে তা দাঁড়ায় ৫৯ বিলিয়নে। এ হিসাবে প্রতিদিন আয় করেছেন ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

সফলতার জন্য কোনো বয়স লাগে না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাফেট। ৫২ বছর বয়সে তাঁর সম্পদ ছিল মাত্র সাড়ে ৩৭ কোটি ডলার। ৬০ বছর বয়সে তা হয় ৩৮০ কোটি। আর ৬০ বছর পার হওয়ার পর তাঁর সম্পদ ৯৪ শতাংশ বাড়ে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এ রমরমা যুগে তিনি নিজে কখনো টুইট করেননি। সাড়ে ১২ লাখ অনুসারীর টুইটার অ্যাকাউন্ট (@WarrenBuffett) থেকে টুইট হয়েছে মাত্র নয়টি।
কেউ বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, এ ধনকুবেরের স্যুট মাত্র ২০টি এবং এগুলোর কোনোটির দাম তাঁকে দিতে হয়নি। চীনের এক ডিজাইনার মাদাম লি এগুলো বানিয়ে দেন। এ ডিজাইনার পরে বিল গেটসসহ অন্যদের স্যুটও তৈরি করে দেওয়ার সুযোগ পান বাফেটের কল্যাণে।
দিনের অধিকাংশ সময় এ প্রজ্ঞাবান ব্যবসায়ী বই পড়ে কাটান। সফলতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক ৫০০ পৃষ্ঠা পড়ার পরামর্শ দেন।

প্রত্যেক কর্মীকে আজীবন প্রতিবছর ১০ লাখ ডলার করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। শর্ত হিসেবে অবশ্য এনসিএএ নামের একটি প্রতিযোগিতার ১৬ দলের নাম চূড়ান্ত করতে হবে। এখন পর্যন্ত কেউ পুরো অর্থ পাননি। শুধু দুজন প্রায় কাছাকাছি যাওয়ায় একবার এক লাখ ডলার পেয়েছিলেন, যা তাঁরা ভাগাভাগি করে নেন।

শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে দারুণ পছন্দ করেন এ বিলিয়নিয়ার। প্রতি রোববার ১২ জন শিশুকে তঁার আইসক্রিম ও ফাস্ট ফুডের চেইন শপ ডেইরি কুইনে নিয়ে যান।

ই-মেইল করেন না বললেই চলে। তাঁর দাবি, জীবনে মাত্র একটি ই-মেইল করেছিলেন এবং সেটি নিয়ে ঝামেলা বাধায় তা আদালতে গড়ায়। ঘটনাটি ১৯৭৭ সালের।

১৮ বছর বয়সে এক তরুণীর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে বাফেট ‘ইউকালেলে’ নামের একধরনের হাওয়াইয়ান গিটার বাজানো শেখেন। ওই তরুণীর প্রেমিক এটি বাজাতে পারতেন না। এটি শিখেও তিনি তরুণীর মন জয়ের ব্যর্থ চেষ্টা করেন।

মানবহিতৈষী এ নির্বাহী ২০০৬ সালে তাঁর আয়ের বলতে গেলে প্রায় পুরোটা দান করার ঘোষণা দেন। বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের ৮৫ শতাংশ পর্যায়ক্রমে পাঁচ দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার কথা জানান। ২০১৬ সালে দিয়েছেন ২৮৬ কোটি ডলার। আগের দুই বছরের পরিমাণও প্রায় একই ছিল।
এ ব্যবসায়ী তারকা জনহিতকর কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১১ সালে বারাক ওবামা ওমাহার স্বপ্নদ্রষ্টাকে প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম প্রদান করেন।
চার্লস মুনগার থেকে শুরু করে পিটার লাইঞ্চের মতো বাঘা বাঘা ও এলিট বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাফেটেরই সবচেয়ে বেশি খ্যাতি রয়েছে শেয়ারবাজারকে জয় করার।

 

Collected

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *