আন্তর্জাতিক ফুটবলে সেরা ৫ প্রতিদ্বন্দ্বী

0

ক্লাব ফুটবলে যেমন সবচেয়ে উত্তেজনা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ বলা হয় এল ক্লাসিকোকে তেমনি আন্তর্জাতিক ফুটবলেও বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে যাদের মধ্যে যখন ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় তখন উত্তেজনার পারদ অনেক উঁচুতে উঠে যায়। কখনো কখনো ফুটবলের উত্তেজনা সবুজ গালিচা ছাড়িয়ে রাজনৈতিক মাঠে চলে যায়। মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কখনো কখনো হয়ে পড়ে দুটি দেশের সম্মান রক্ষার লড়াই, দুটি দেশের মর্যাদা রক্ষার লড়াই। ঐতিহাসিক কারণ হোক কিংবা ভৌগোলিক কোনো কারণে হোক আন্তর্জাতিক ফুটবলে বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে যাদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচ মানেই উত্তেজনায় ভরপুর। চলুন দেখে নেই আন্তর্জাতিক ফুটবলে যে ৫ টি দেশের মধ্যে রয়েছে তুমুল প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

ফ্রান্স -ইতালি

ইউরোপের দুই পরাশক্তি ফ্রান্স এবং ইতালির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশ আগে থেকেই। এই দুই দেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মূলে রয়েছে ভৌগোলিক কিছু কারণ। বর্তমানে ফ্রান্স এবং ইতালির মধ্যে বেশ সুসম্পর্ক থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দুই দেশ ছিলো একে অপরের প্রতিদ্বন্দী। ফ্রান্স এবং ইতালির এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফুটবল মাঠে এখনও বর্তমান, যদিও সেটা রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ায় না এখন। ১৯৮২ সালের পূর্ব পর্যন্ত ফ্রান্স ইতালিকে কখনোই হারাতে পারেনি। সেই সময়ে ইতালি ছিলো ৩ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কিন্তু ফ্রান্সের কোন শিরোপা ছিল না। ১৯৮২ সালের পর ফরাসিরা ইতালির চেয়ে অনেক বেশী এগিয়ে যায়।

২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইতালি এবং ফ্রান্স; Source: fr.fifa.com

যার মধ্যে ১৯৯৮ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্স ইতালিকে টাইব্রেকারে হারিয়ে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত তারা বিশ্বকাপও জিতে নেয়। তবে ফ্রান্স ইতালির প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেখানেই শেষ নয় এরপরেও দুটি দেশ দুটি বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে মুখোমুখি হয়। যার মধ্যে একটি ছিল ২০০০ সালে ইউরো ফাইনাল এবং ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনাল।

দুটি ফাইনালে মধ্যে একটি জিতেছে ফ্রান্স এবং একটি জিতেছে ইতালি। ২০০০ সালের ইউরো ফাইনালে ডেভিড ট্রেজাগুয়েতের অসাধারণ এক গোলের মাধ্যমে ফ্রান্স ইতালিকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয়। অন্যদিকে ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ ফাইনালে টাই ব্রেকারে ফ্রান্সকে হারিয়ে চতুর্থ বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ইতালি। সর্বশেষ এই দুটি দেশ মুখোমুখি হয়েছিল ২০০৮ সালের ইউরোতে। সেই ম্যাচটি ২-০ গোলে জিতে নেয় ইতালি এবং তারা বিদায় করে দেয় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রান্সকে।

জার্মানি-ইতালি

জার্মানি এবং ইতালি শুধুমাত্র বিশ্বকাপের অন্যতম সফল দুটি দল সেটাই নয়, তারা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও অন্যতম সফল দুটি দল। জার্মানি এবং ইতালি দুই দলই চারবার করে মোট আটবার বিশ্বকাপ জিতেছে। সেই সাথে ইউরো জিতেছে মোট পাঁচবার যার মধ্যে জার্মানি চারবার এবং ইতালি জিতেছে একবার। ইতালি এবং জার্মানির মধ্যে বর্তমানে রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক কিংবা ভৌগলিক কোনো শত্রুতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলেও তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে ফুটবল মাঠে।

জার্মানি এবং ইতালির লড়াই; Source: goal.com

ইতালি এবং জার্মানির মধ্যে বেশ কয়েকটি ম্যাচ রয়েছে যেগুলো খেতাব পেয়েছে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচের। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ম্যাচটি। ১৯৭০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ম্যাচটিকে বলা হয় ম্যাচ অব দ্য সেঞ্চুরি’। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি ৪-৩ গোল ব্যবধানে জিতে নেয় ইতালি এবং ম্যাচের মোট ৭ গোলের মধ্যে পাঁচটি গোল হয় অতিরিক্ত সময়ে।

এরপরেও অনেকগুলো ম্যাচে মুখোমুখি হয় জার্মানি এবং ইতালি যার মধ্যে অধিকাংশ ম্যাচে জিতেছে ইতালি। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ গুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৮২ বিশ্বকাপের ফাইনাল, ২০০৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল এবং ২০১২ ইউরো সেমিফাইনাল। এই তিনটি ম্যাচেই জিতেছে ইতালি। কিন্তু ২০১২ সালের পর থেকে ইতালি জার্মানির বিপক্ষে কখনো জিততে পারেনি। ২০১২ সালের পরে তারা ২০১৬ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়। যে ম্যাচটি ছিল অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাময়। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে ড্র থাকার পর ম্যাচটি গড়ায় ট্রাইবেকারে। সেখানে ৫-৫ গোলে সমতা থাকার পর সাডেন ডেথে ম্যাচটি জিতে নেয় জার্মানি।

সৌদি আরব- ইরান

মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি দেশ সৌদি আরব এবং ইরান মধ্যপ্রাচ্যে শক্তি বিস্তার করতে সব সময় একে অপরের বিপক্ষে লড়াই করে যাচ্ছে। শিয়া প্রধান ইরান এবং সুন্নি প্রদান সৌদি আরবের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে। তবে এই দুটি দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেখানেই থেমে নেই, তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছড়িয়ে পড়েছে ফুটবল মাঠেও। ফুটবলে যদিও এই দুটি দেশ খুব বেশি ভালো ফলাফল করতে পারেনি।

চিরশত্রু সৌদি আরব এবং ইরানের ফুটবলের লড়াই; Source: dailystar.com.lb

তবে এশিয়ার হয়ে দুটি দেশই সর্বশেষ রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলেছে। এছাড়া নিজেদের মধ্যে তারা মোট ১৫টি ম্যাচ খেলেছে যার মধ্যে পাঁচটি ম্যাচ জিতেছে ইরান এবং চারটি ম্যাচ জিতেছে সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও ছায়া যুদ্ধরত এই দুটি দেশের ক্লাবগুলোর মধ্যেও রয়েছে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ২০১৬ সালে ইরানে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ খেলতে অস্বীকৃতি জানায় সৌদি আরবের ক্লাব। মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ নিজেদের মর্যাদা রক্ষার লড়াই হিসেবে নেমে পড়ে ফুটবল মাঠে। সে কারণে এই দুই দেশের মধ্যকার ফুটবল ম্যাচ অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে দুটি দেশের মানুষের কাছে।

জার্মানি – নেদারল্যান্ড

জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডের মধ্যে বর্তমানে কোন শত্রুতা না থাকলেও তাদের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঐতিহাসিক শত্রুতা রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি নেদারল্যান্ডকে আক্রমণ করে। সেই কারণে অনেক ডাচ এখনো জার্মানদের ঘৃণা করে থাকেন। জার্মানদের সাথে সেই শত্রুতা থেকেই হোক কিংবা ফুটবলের শক্তির দিক থেকেই হোক জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডের মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচগুলো বেশ উপভোগ্য হয়ে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় জার্মানি এবং নেদারল্যান্ড। সেই ম্যাচে শক্তিমত্তার দিক থেকে এগিয়ে ছিলো ইয়োহান ক্রুইফের নেদারল্যান্ড। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি হেরে যায় ডাচরা।

জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডের ম্যাচের একটি মূহুর্ত; Source: goal.com

এরপরে অনেকগুলো ম্যাচে নেদারল্যান্ড এবং জার্মানি মুখোমুখি হয়। ডাচরা ‘৭৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের প্রতিশোধ নেয় ১৯৮৮ ইউরো সেমিফাইনালে। সেই ম্যাচে জার্মানিকে হারিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দেয় নেদারল্যান্ড। এরপর ১৯৯০ বিশ্বকাপ এবং ২০১০ বিশ্বকাপে মুখোমুখি হয় জার্মানি এবং নেদারল্যান্ড। ২০১০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানদের হারিয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দেয় নেদারল্যান্ড। এই দুটি দেশ মোট ৪০ বার মুখোমুখি হয়েছে যার মধ্যে ১৫টি ম্যাচ জিতেছে জার্মানি এবং ১০টি ম্যাচ জিতেছে নেদারল্যান্ড। সর্বশেষ তারা ২০১০ সালের ইউরোতে গ্রুপ পর্বে মুখোমুখি হয় এবং ম্যাচটি ২-০ গোলে জিতে নেয় জার্মানি।

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা

বার্সা-রিয়ালের লড়াইকে বলা হয় এল ক্লাসিকো কিন্তু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা লড়াইকে বলা হয় সুপার ক্লাসিকো। ফুটবলের এই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের ম্যাচ দেখার জন্য সারা বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল ভক্তরা অধীর অপেক্ষায় বসে থাকেন। বিশ্বকাপ কিংবা কোপা আমেরিকা কিংবা কোন প্রীতি ম্যাচ যখনই এই দুটি দেশ মুখোমুখি হয় তখন পুরো বিশ্ব যেন বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়েছে সেই ১৯১৪ সাল থেকে। তবে ১৯৩৭ সালের কোপা আমেরিকা ফাইনালে প্রথমবারের মতো বড় কোনো ম্যাচে মুখোমুখি ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা।

ফুটবলের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ব্রাজিল -আর্জেন্টিনার লড়াই; Source: foottheball.com

ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত জিতে নেয় আর্জেন্টিনা । এরপর বিশ্বকাপের মঞ্চে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় ১৯৬৮ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে এবং ১৯৯০ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে। এই দুটি ম্যাচ বিখ্যাত আছে ব্যাটল অব রোজারিও এবং হলি ওয়াটার স্ক্যান্ডাল নামে। এই দুটি ম্যাচের মধ্যে প্রথম ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হলেও দ্বিতীয় ম্যাচটি জিতে নেয় আর্জেন্টিনা।

এরপর ১৯৯১ সালে কোপা আমেরিকার ফাইনালে আবারো মুখোমুখি হয় ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। যে ম্যাচে ব্রাজিল কে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় আর্জেন্টিনা। লাতিন আমেরিকার এই দুটি দেশ মোট ১০৮ বার মুখোমুখি হয়েছে। যার মধ্যে ৪৪টি ম্যাচ জিতেছে ব্রাজিল এবং ৩৯টি ম্যাচ জিতেছে আর্জেন্টিনা। বাকি ম্যাচগুলো ড্র হয়েছে। সর্বশেষ ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় ২০১৬ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে। যে ম্যাচটি ৩-০ গোলে জিতে নেয় ব্রাজিল। যুগের পর যুগ ধরে যেমন ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা মধ্যে কে সেরা সেটা নিয়ে বিতর্ক চলমান তেমনি বিতর্ক চলমান ম্যারাডোনা এবং ছেলের মধ্যে কে সেরা। বর্তমান ক্লাব ফুটবলের রাজত্ব করছেন দুই এই দুই দেশের দুই ফুটবলার লিওনেল মেসি এবং নেইমার।

 

Featured Image: foottheball.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *