ফুটবল ইতিহাসে স্পেনের উঠে আসার গল্প ১


একবিংশ শতাব্দীতে যে কয়েকটি দেশ তাদের নান্দনিক ফুটবল খেলা দিয়ে ফুটবল প্রেমীদের  মাতিয়েছে তাদের মধ্যে স্পেনের নামটি প্রথম সারিতে থাকবে। ক্লাব ফুটবল কিংবা আন্তর্জাতিক ফুটবল যেটাই বলা হোক না কেন স্পেন এবং স্প্যানিশ ফুটবলারদের প্রাধান্য ছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে সবজায়গায়। এমনকি স্প্যানিশ কোচরা ও শাসন করছেন ফুটবল বিশ্বকে। বেলজিয়ামের কোচ রবার্তো মার্টিনেজ, ম্যানচেস্টার সিটির কোচ পেপ গার্দিওলা, সদ্য নিযুক্ত আর্সেনালের কোচ উনাই এমেরি, নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের কোচ রাফা বেনেতিজ, মালাগার সাবেক কোচ জোসে মিগুয়েল। লিভিয়ার সাবেক কোচ হ্যাভিয়ের ক্লিমেন্ট,স্পেনের সাবেক কোচ ভিসেন্তে দেল বস্ক, বার্সেলোনার সাবেক কোচ লুইস এনরিকে এবং স্পেনের বর্তমান কোচ জুয়েন লোপেতেগুই, এই নাম গুলো অন্তত আমাদের স্পেনের ফুটবল ঐতিহ্য এবং গভীরতা সম্পর্কে ধারনা দেয়।

Image result for spain world cup 2018 squad


স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন গঠিত হয় 1920 খ্রিস্টাব্দে। ফুটবল ফেডারেশনের নাম রয়্যাল স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন। স্পেন ফুটবল দলকে সাধারনত লা রোজা ফুরিয়া বা লাল শিখা নামে ডাকা হয়ে থাকে। সাধারনত স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুকে নিজেদের প্রধান মাঠ হিসেবে ব্যাবহার করে স্পেন। ফিফা র‍্যাংকিয়ে কখনো 25 এর বাহিরে যায়নি ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী এই দেশটি। আর বর্তমান ফিফা র‍্যাংকিয়ে ও আছে 8 নম্বর পজিশনে। এই বিশ্বকাপের ও অন্যতম ফেভারিট স্পেন।

 

Image result for spain world cup 2018 squad

 

স্পেন ফুটবল দলের বর্তমান অধিনায়ক সার্জিও রামোস। স্পেনের সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার কৃতিত্ব ইকার ক্যাসিয়াসের । তিনি স্পেনের হয়ে 167 টি ম্যাচ খেলেছেন। 59 টি গোল করে শীর্ষ গোল দাতার তালিকার প্রথমে আছেন ডেভিড ভিয়া। ইউরোপের একমাত্র দেশ হিসেবে ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো জেতার রেকর্ড আছে স্পেনের। 2008 খ্রিষ্টাব্দে ষষ্ঠ দল হিসেবে প্রথমবার ফিফা র‍্যাংকিয়ে উঠে আসে স্পেন। 2006 খ্রিষ্টাব্দ থেকে 2009 খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টানা 35 টি আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ড করে স্পেন। যেটি এর পুর্বে একমাত্র ব্রাজিলের আয়ত্বে ছিল। এইসময় স্পেন টানা 15 টি ম্যাচ জয়ের রেকর্ডও করেছিল।

 

Image result for spain world cup 2018 squad
স্পেন তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে। 1920 খ্রিস্টাব্দের 28 অগাস্ট বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত সামার অলিম্পিকের এই ম্যাচে ডেনমার্ক কে 1-0 গোলে হারায় স্পেন। স্পেনের হয়ে গোলটি করেছিলেন প্যাট্রিকো আরবালোজো। আর প্রতিষ্ঠার বছরেই সেই সামার অলিম্পিকের রোপ্য  নিজেদের করে নেয় স্পেন। 1933 খ্রিস্টাব্দের 21 মে বার্নাব্যুতে বুলগেরিয়া কে 13-0 গোলে হারায় স্পেন। যেটি স্পেনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয়। আবার এর সাথে সাথে দুবার সেভেন আপ হজম করার রেকর্ড আছে স্পেনের। 1928 খ্রিস্টাব্দের 4 জুন নেদ্যারল্যান্ডসে ইতালির বিপক্ষে 7-1 এবং 1931 খ্রিস্টাব্দের 9 ডিসেম্বর লন্ডনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে 7-1 গোলে হার।


ইউরোতে স্পেনঃ


ইউরো কাপে স্পেন অংশ নেয় 1964 খ্রিষ্টাব্দে আর এখন পর্যন্ত অংশ নিয়েছে 10 বার। চ্যম্পিয়ন হয় 1964,2008 এবং 2012 মিলিয়ে এই পর্যন্ত 3 বার।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন কে বার্ন্যাবুতে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথম আসরের শিরোপা নিজেদের করে নিয়ে লা রোজারা। এর আগে সেমিফাইনালে হাঙ্গেরী কে ২-১ গোলে এবং ডেনমার্ক কে ৩-০ গোলে হারায় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ইউরোকাপে ই গ্রূপে সুইডেন , রাশিয়া, এবং গ্রীসের সাথে পড়ে তারা। গ্রূপ রাউন্ডে রাশিয়া কে ৪-১, সুইডেন কে ২-১, এবং গ্রীসকে ২-১ গোলে হারিয়ে গ্রূপ চ্যাম্পিয়ন হয়। নক আউট স্টেজ ইতালি কে ট্রাইব্রেকারে (৪)০-০(২) হারিয়ে সেমিতে চলে যায় তারা।  সেমিতে আবার রশিয়া কে পায়, আর এবার ৩-০ গোলে হারিয়ে চলে যায় ফাইনালে। আর ফাইনালে ৩৩ মিনিটে ফার্নান্দো তরেসের একমাত্র গোলে জার্মানীকে ১-০ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন হয় স্পেন।

২০১২ ইউরো কাপে ডিপেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন এবং বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে ইউরোকাপে যায় তারা। গ্রূপ সি তে ইতালি, ক্রোয়শিয়া এবং আয়ারল্যন্ডের সাথে পড়ে স্পেন। গ্রূপ স্টেজে ইতালির সাথে ১-১ গোলে ড্র করলে ও আয়ারল্যান্ডকে ৪-০ এবং ক্রোয়েশিয়া কে ১-০ গোলে হারায় স্পেন। গ্রূপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই যায় নক আউট স্টেজে। নক আউটে ফ্রান্স কে ২-০ গোলে হারিয়ে সেমিতে চলে যায় তারা। সেমিতে পর্তুগাল কে ট্রাইব্রেকারে (৪)০-০(২) গোলে হারিয়ে ফাইনালে চলে যায় তারা। অপরদিকে জার্মানীকে ১-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে আসে ইতালি। ফাইনালে ইতালিকে ৪-০ গোলের বড় ব্যাবধানে হারিয়ে তৃতীয়বারের মত শিরোপা জিতে নেয় স্পেন।

 

ফুটবল বিশ্বকাপে স্পেন


১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া স্পেন এখন পর্যন্ত ১৫ বার বিশ্বকাপে অংশগ্রহন করেছে। আর প্রথম বিশ্বকাপে এসেই ৫ স্থান অর্জন করে স্পেন। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই স্পেন ব্রাজিলকে ৩-১ গোলে হারায়। স্পেনের হয়ে  বিশ্বকাপের প্রথম গোল টি করেছেন ইরারাগরি, পেনাল্টি থেকে। পরে আরো একটি গোল করেছেন তিনি। সেই বিশ্বকাপে কোয়াটার ফাইনালে ইতালির কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল স্পেন। কোয়াটার ফাইনালে প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হয় স্পেন আর ইতালি। ম্যাচ টি ১-১ গোলে ড্র হয়। ম্যাচে দুই দলই মাত্রাতিরিক্ত রাফ ট্যাকল করে খেলেছিল। দুই দলের খেলোয়াড়ই ইঞ্জুরিত পড়েন। সেই সময় ফিফার নিয়ম অনুযায়ী কোন ম্যাচ ড্র হলে সেটি আবার অনুষ্ঠিত হবে। আর সেই নিয়মে ম্যাচটি আবার মাঠে গড়ায়। প্রথমে ইঞ্জুরিতে পড়ার কারনে পরের ম্যাচে খেলতে পারেনি স্প্যানিশ গোল কিপার রিকার্ড জ্যামোরা। অপর দিকে স্প্যানিশরা ইতালির মারিও পিজ্জলোর পা ভেঙ্গে দেয়। যার কারনে সে আর কখনো ফুটবল খেলতেই পারেনি। পরের ম্যাচটি ইতালি ১-০ জিতে সেমিতে চলে যায়। স্পেন বনাম ইতালির এই ম্যাচটি ইতিহাসের একটি নিকৃষ্ট ম্যাচ হিসেবে বিবেচিত হয়।  

 

Related imageএর পরের বিশ্বকাপে স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের কারনে বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারেনি স্পেন।


১৯৫০ খ্রিস্ট্রাব্দের ব্রাজিল বিশ্বকাপে চতুর্থ হয় স্পেন। এই বিশ্বকাপ টি অনুষ্ঠিত হয় রবিন রাউন্ড সিস্টেমে। রাউন্ড রবিন গ্রূপ পর্ব থেকে ৪ টি দল রবিন ফাইনাল রাউন্ডে উঠে আসে।  গ্রূপ থেকে ব্রাজিল, বি গ্রূপ থেকে স্পেন, সি গ্রূপ থেকে সুইডেন, ডি গ্রূপ থেকে উরুগুয়ে। ফাইনাল রবিন রাউন্ডে ১ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ হয় স্পেন ,আর সর্বোচ্চ ৫ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে, ৪ পয়েন্ট নিয়ে রানার্স আপ ব্রাজিল।

১৯৫৪ এবং ১৯৫৮ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে স্পেন। ১৯৬২ বিশ্বকাপে গ্রূপ থ্রি তে ব্রাজিল, চেকোস্লোভাকিয়া এবং মেক্সিকোর সাথে পড়ে। গ্রূপ রাউন্ডে চেকোস্লোভাকিয়ার সাথে ১-০, ব্রাজিলের সাথে ২-১, গোলে হেরে যায়। মেক্সিকো কে ১-০ গোলে হারালে ও শেষ রক্ষা হয়নি। গ্রূপ রাউন্ডেই বাড়ি ফিরে আসে স্পেন


১৯৬৬ বিশ্বকাপে পশ্চিম  জার্মানী, আর্জেন্টিনা, সুইজারল্যান্ডের সাথে গ্রূপ-২ এ পড়ে স্পেন। আর্জেন্টিনার সাথে ২-১, পশ্চিম জার্মানীর সাথে ২-১ ব্যাবধানে হের যায়, তবে সুজারল্যান্ড কে ২-১ হারায় স্পেন। এবারো শেষ রক্ষা হয় নি। বাড়ি ফিরে আসে স্পেন।
পরের দুইটি বিশ্বকাপ ১৯৭০ এবং ১৯৭৪ এ আবারো কোয়লিফাই করতে ব্যর্থ হয়। স্পেন। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে আবারো ব্রাজিল, অস্ট্রিয়া, সুইডেনের সাথে গ্রূপ থ্রি তে পড়ে স্পেন। এবার অস্ট্রিয়ার সাথে ২-১ হারে, ব্রাজিলের সাথে ০-০ ড্র, সুইডেনের ১-০ জয় নিয়ে গ্রূপ পর্বে আবারও বিদায় নেয় স্পেন।

১৯৮২ বিশ্বকাপ। এবার নিজেরাই আয়োজক । গ্রূপ – ৫ এ নর্দান আয়ারল্যান্ড, যুগোশ্লাভিয়া এবং হুন্ডূরাসের সাথে পড়ে স্পেন। হুন্ডূরাসের সাথে ১-১ গোলে ড্র, যুগোশ্লাভিয়া কে ২-১ গোলে হারায়, আর নর্দান আয়ারল্যান্ডের সাথে ০-১ গোলে হেরে যায়। তবে ৩ পয়েন্ট নিয়ে গ্রূপ রানার্স আপ হয়ে পরবর্তী রাউন্ডে চলে যায় স্পেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে পশ্চিত জার্মানীর কাছে ২-১ গোলে এবং ইংল্যান্ডের সাথে 0-0  ড্র করে এখানে সমাপ্তি ঘটায় তাদের বিশ্বকাপের।

 


১৯৮৬ বিশ্বকাপে গ্রূপ ডি তে ব্রাজিল, নর্দান আয়ারল্যান্ড এবং আলজেরিয়ার সাথে পড়ে। ব্রাজিলের সাথে ০-১ গোলে হারলে ও নর্দান আয়ারল্যন্ডকে ২-১ গোলে এবং আলজেরিয়া কে ৩-০ গোলে হারায় স্পেন। গ্রূপ রানার্স আপ হয়ে যায় রাউন্ড ১৬ তে। রাউন্ড ১৬ ডেনমার্ক কে ৫-১ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যায় স্পেন। কোয়ার্টারে বেলজিয়ামের সাথে  ট্রাইব্রেকারে হের যায় বিদায় নেয় স্পেন।

১৯৯০ বিশ্বকাপে বেলজিয়াম, উরুগুয়ে এবং দক্ষিন কোরিয়ার সাথে  গ্রূপ ই তে পড়ে। উরুগুয়ের সাথে গোল শূন্য ড্র করলে ও বেলজিয়াম ২-১ গোলে এবং দক্ষিণ কোরিয়া কে ৩-১ গোলে হারিয়ে স্পেন গ্রূপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নক আউট স্টেজে যায় স্পেন। নক আউট স্টেজে  এবার যুগোশ্লাভিয়ার কাছে ২-১ গোলে হেরে আবারো বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় স্পেন।

১৯৯৪ বিশ্বকাপে গ্রূপ সি তে জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া এবং বলিভিয়ার সাথে পড়ে স্পেন। জার্মানির সাথে ১-১ গোলে ড্র, দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ২-২ গোলে ড্র, আর বলিভিয়া কে ৩-১ হারিয়ে গ্রূপ রানার্স আপ হয়ে পরবর্তী রাউন্ড নিশ্চিত করে স্পেন। নক আউট স্টেজে সুইজারল্যান্ড কে ৩-০ গোলে হারিয়ে কোইয়ার্টার ফাইনালে যায় স্পেন। আর কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালির সাথে ২-১ গোলে হেরে বাদ পড়ে স্পেন।


১৯৯৮ বিশ্বকাপে নাইজেরিয়া, প্যারাগুয়ে এবং বুলগেরিয়ার সাথে গ্রূপ ডি তে পড়ে স্পেন। গ্রূপ রাউন্ডে নাইজেরিয়ার সাথে ২-৩ গোলে হার, আর প্যারাগুয়ের সাথে 0-0 গোলে ড্র। আবার বুলগেরিয়াকে হারায় ৬-১ ব্যাবধানে। কিন্তু ফলাফল গ্রূপ রাউন্ড থেকে বিদায়।

২০০২ কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপ। গ্রূপ বি তে প্যারাগুয়ে, সাউথ আফ্রিকা, স্লোভেনিয়া। স্লোভেনিয়া কে ৩-১ গোলে, প্যারাগুয়ে কে ৩-১ গোল, সাউথ আফ্রিকাকে ৩-২ গোলে হারিয়ে গ্রূপ চ্যাম্পিয়ন স্পেন।  নক আউট স্টেজে আয়ারল্যন্ডকে ট্রাইব্রেকারে ১(৩)- ১(২) হারিয়ে কোয়াটার ফাইনালে যায় স্পেন। কোয়াটার ফাইনালে স্বাগতিক দক্ষিন কোরিয়ার সাথে ০(৩)-০(৫) ট্রাইব্রেকারে হেরে বিদায় নেয় স্পেন।

 

Written By

Mohammad Ali

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *