রোহিঙ্গারা রিফিউজি’ না ‘আইডিপি ?? : মেজর ডি এইচ খান

‘রিফিউজি’ আর ‘আইডিপি’ র ভেতর সামান্য তফাত আছে।

জানের মায়ায় যখন কেউ ভিটেমাটি ছেড়ে নিজের দেশেই অপেক্ষাকৃত সেইফ এলাকায় মাইগ্রেট করে, তখন তাকে বলে ‘আইডিপি’ মানে ‘ইন্টারনালি ডিস্পলেসড পার্সোন/পিপল’; সিভিল ওয়ার জনিত কারনে কংগো, কার, কাশ্মীর, সিরিয়া, আফগানিস্তান, বার্মা সহ সারাবিশ্বে ৩৭ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আজ আইডিপি।

আর এই ঘরছাড়া মানুষগুলো যখন দেশছাড়া হয়ে অন্যদেশে মাইগ্রেট, তখন ওরা হয়ে যায় ‘রিফিউজি।’ যেমন ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান ইহুদীরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ভারতে, কিংবা বার্মায় এথনিক ক্লিঞ্জিং এর সময় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে রিফিউজি হিসেবে আশ্রয় নেয়।

মানুষ নিরাপদ আর উন্নততর এলাকায় মাইগ্রেট করে, অবশ্য কেউ স্বেচ্ছায় ভিসা পাসপোর্ট নিয়ে মাইগ্রেট করে, কেউ রিফিউজি হয়ে। মায়ানমারে প্ল্যানড রোহিঙ্গা ক্লিঞ্জিং এর সাথে অনেকে হিটলারের ইহুদী নিধন ‘দ্য হলোকাস্ট’ এর মিল খুঁজে পান। অগত্যা অসহায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে অথবা করতে বাধ্য হচ্ছে।

রোহিঙ্গা রিফিউজিদের অনুপ্রবেশ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। একদল বলছে সীমান্ত খুলে দাও; ‘৭১ এ ভারত যেমন আমাদের ঠাই দিয়েছিল। আরেক দল বলছে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাও, আমরা নিজেদের সমস্যা নিয়েই যথেস্ট জর্জরিত!

বাংলাদেশ ঐতিহাসিক ভাবেই অনন্য এক দেশ! মহাস্থানগড় আর পাহাড়পুরের মত হেরিটেজ আমাদের ছিল, বিখ্যাত মসলিন আমরাই বানাতাম, আমরাই ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, নয়মাসে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি, আমাদের আছে লংগেস্ট স্যান্ডি সি বিচ, ক্রিকেট আর শান্তিরক্ষায় আমরাই উঠতি পরাশক্তি!

আমির খানের ‘থ্রি ইডিয়টস’ মুভিটা দারুন! ঐ মুভিতে একটা ডায়লগ আছে, “দোস্ত পরীক্ষায় ফেইল করলে অনেক কষ্ট লাগে, কিন্তু পরীক্ষায় ফার্স্ট হইলে আরো বেশি কস্ট লাগে!” ওয়ার্ল্ড ইকোনমি আর ডিপ্লোম্যাসিতে বাংলাদেশ দিনকে দিন প্রমিনেন্স গেইন করবে আর বার্মারা বসে বিসে বার্মিজ আচার চুষবে, এমনটা ভাবাই ভুল। বরং বর্ডার বরাবর এক বন্ধু ফেন্সিডিলের ফ্যাক্টরি, আরেক বন্ধু ইয়াবার কারখানা বসায়া দিবে এইটাই হয়ত স্বাভাবিক, যেমন থ্রি ইডিয়টে ‘চতুর ত্রিবেদী’ পরীক্ষার আগের রাতে বন্ধুদের রুমের দরজার নিচ দিয়ে চটি সাপ্লাই করত যেন ওরা পড়ায় মন দিতে না পারে।

রোহিঙ্গারা কোন ধর্মাবলম্বী তার চে ইম্পর্ট্যান্ট একটা এথনিসিটি হারিয়ে যেতে বসেছে। আমরা লুপ্তপ্রায় পশুপাখি নিয়ে সোচ্চার, অথচ রোহিঙ্গাদের ক্রমবিলুপ্তি নিয়ে নির্বিকার প্রায়! প্রত্যেক মানুষেরই বাঁচবার অধিকার আছে, যে কোন পশুপাখির চে অনেক অনেক বেশি করেই আছে। কিন্তু জেনেভা ক্যাম্পে আটকে পরা পাকিস্তানী রিফিউজিদের পাশাপাশি লাখোলাখো রোহিঙ্গা রিফিউজি পুষবার সামর্থ্য কী আমাদের অর্থনীতির আছে?

পুনশ্চঃ
একঃ সহজ বাংলায় আইডিপিদের ‘উদ্বাস্তু’ আর রিফিউজিদের ‘শরণার্থী’ বলা যেতে পারে।

দুইঃ ‘৭১ এ ভারত তার নিজস্ব তাগিদেই সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল, আর যুদ্ধ শেষে আমাদের রিফিউজিরা স্বেচ্ছায় দেশে ফিরেও এসেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গারা কী কখনো ফিরে যাবে? তাই দুইটাকে একই ইস্যু ভাবাটা বোধহয় ঠিক হবে না।

ট্রিভিয়াঃ

একঃ
রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোডপায়া এটি দখল করে বার্মার অধীন করদ রাজ্যে পরিণত করেন।

আরাকান রাজ্যের রাজা বৌদ্ধ হলেও তিনি মুসলমান উপাধি গ্রহণ করতেন। তার মুদ্রাতে ফার্সি ভাষায় লেখা থাকতো কালেমা।

আরাকান রাজ দরবারে কাজ করতেন অনেক বাঙালি মুসলমান। বাংলার সাথে আরাকানের ছিল গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক।

ধারণা করা হয় রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে: ম্রোহং>রোয়াং>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা। তবে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে ডাকা হতো রোসাং নামে।

১৪০৬ সালে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে পলায়ন করেন। গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ্ নরমিখলার সাহায্যে ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে বর্মী রাজাকে উৎখাতে সহায়তা করেন। নরমিখলা মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ্ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। ম্রাউক-উ রাজবংশ ১০০ বছর আরাকান শাসন করেছে।

মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চ্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং রাজ দরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজ কবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মহাকাব্য পদ্মাবতী। এছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুল মুল্ক, জঙ্গনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে।

ভাই আওরঙ্গজেবের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়ে মোগল যুবরাজ শাহ্ সুজা ১৬৬০ সালে সড়ক পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে আরাকানে পলায়ন করেন। তৎকালীন রোসাং রাজা চন্দ্র সুধর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ্ সুজা এবং তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এর পর আরাকানে যে দীর্ঘমেয়াদী অরাজকতা সৃষ্টি হয় তার অবসান ঘটে বার্মার হাতে আরাকানের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে।
(সূত্র: রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস, এন. এম. হাবিব উল্লাহ্, এপ্রিল-১৯৯৫)

দুইঃ
ইতিহাস এটা জানায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।

এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তখন বড় ধরনের ভুল করে তারা এবং এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে প্রশ্ন জ্বলন্ত। তারা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ ধরনের বহু ভূল করে গেছে ব্রিটিশ শাসকরা।

তিনঃ
১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ।

মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা ‘কালা’ বলে। ভারতীয়দেরও একই পরিচিতি। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা।

তিনঃ
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বলা হয় “বিশ্বের সবচেয়ে কম প্রত্যাশিত জনপদ” এবং “বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু”। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের ফলে তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হন। তারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারে না, জমির মালিক হতে পারে না এবং দুইটির বেশি সন্তান না নেওয়ার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনুসারে, ১৯৭৮ সাল থেকে মায়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গারা মানবাধিকার লংঘনের শিকার হচ্ছে এবং তারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
(সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)

পুনঃপুনশ্চঃ
আচ্ছা, রোহিঙ্গারাও কী আদিবাসী?

Writer : Major Del H Khan

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *