স্বাস্থ্য ক্যাডার ও জাতীয় বেতন কাঠামো বৈষম্য কি চলতেই থাকবে?

স্বাস্থ্য বিভাগ সম্পর্কে সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সবার একটি নেতিবাচক ধারণা আজ প্রায় প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে আমরা দূরে আছি বলে আজ আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতির এই করুণ পরিণতি। চিকিৎসক হওয়া মানে অনেক বেশি মানবিক হওয়ার পরিবর্তে অনেক বেশি বিত্তবান হওয়া- এই স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের দেশে চিকিৎসা পেশায় মেধাবীরা তাঁদের মেধা বিনিয়োগ করে থাকেন। রসিকতা করে তাই অনেকে বলেন, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা উচ্চ মাধ্যমিক পাস। এই রসিকতা হয়তো চিকিৎসকদের আহত করে না। কিন্তু রাষ্ট্র যখন তাঁদের সঙ্গে নির্মম রসিকতা করে, তখন সত্যিই কিন্তু ডাক্তারদের আহত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। লেখাপড়া শেষ করার পর পিএসসির অভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাডারের মতো চিকিৎসা ক্যাডারের কর্মকর্তা হন চিকিৎসকরা। চাকরির একই বিধিমালা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা বিসিএস কর্মকর্তাদের। অথচ কী এক অজ্ঞাত কারণে চিকিৎসকরা পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হন, তার সমাধান আজ পর্যন্ত হয়নি।

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন দেশের বিসিএস (বাংলাদেশ ক্যাডার সার্ভিস) পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যাডারভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে থাকে। বর্তমানে ২৮টি ক্যাডারে এ নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ক্যাডারগুলোতে রয়েছে বিবিধ মাত্রার বৈষম্য। কখনো পদোন্নতিবৈষম্য, কখনো কর্তৃত্ববৈষম্য। এ ক্যাডারগুলোর মধ্যে কোনো কোনো ক্যাডার অত্যন্ত লোভনীয়, যেমন কোনো কোনো ক্যাডার রয়েছে যেগুলোতে বিত্তের পাহাড় গড়ে তোলা যায়, কেউ কেউ সেগুলো পছন্দ করেন, কেউ কেউ পছন্দ করেন ক্ষমতার দাপট, কেউ কেউ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার কারণে অপছন্দের ক্যাডার নেন। বিসিএস পরীক্ষায় সাধারণত পছন্দের প্রথম তালিকায় থাকে পররাষ্ট্র, দ্বিতীয়ত প্রশাসন, তৃতীয়ত পুলিশ। পছন্দের তালিকায় এ ক্রম ঠিক না থাকলেও এ তিনটির মধ্যেই সাধারণত প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় থাকে। এরপর আর ঠিক থাকে না। এর বাইরে যাঁরা প্রকৌশলী, চিকিৎসক কিংবা কৃষিবিদ রয়েছেন তাঁরা সাধারণত টেকনিক্যাল ক্যাডারেই থাকেন। যাঁরা প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ হন তাঁরা তুলনামূলক অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি মেধাবী। তবে কর্মক্ষেত্রে এই মেধাবীরা তুলনামূলক উপেক্ষিত তার মধ্যে স্বাস্থ্য ক্যাডারের চেয়ে কর্মক্ষেত্রে অবহেলিত অবস্থা আর কোনোটিতেই নেই।

বিসিএস পরীক্ষার সময় যে যোগ্যতার ভিত্তিতে পরীক্ষা হয়, তাতে চিকিৎসা ক্যাডারের অনেকেই অন্য অনেক ক্যাডারের চেয়ে বেশি দিনের শিক্ষাজীবন নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে থাকেন, তারপরও তাঁদের পদোন্নতি পাওয়ার সময় আরও বেশি ডিগ্রি চেয়ে তাঁদের প্রতি অবহেলা প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তার সমান অথবা অধিক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা ক্যাডারদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, যা হওয়া উচিত নয়। ২৮টি ক্যাডারের মধ্যে স্বাস্থ্য ক্যাডার একমাত্র ক্যাডার, যেখানে প্রবেশকালীন যোগ্যতার চেয়ে আরও অনেক বেশি ডিগ্রি প্রয়োজন হয় পদোন্নতিতে। অন্য সব ক্যাডারে প্রবেশকালীন যোগ্যতাই তাঁকে সর্বোচ্চ পদে আসীন করার জন্য যথেষ্ট। চাকরিতে যোগদানের পর বিভাগীয় পরীক্ষা, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা শেষে অন্যসব ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতির জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হন। পদোন্নতির সময় দেখা যায়, উচ্চ মাধ্যমিক শেষে যাঁরা তিন কিংবা চার বছর লেখাপড়া করে এসেছেন, তাঁরাই পদোন্নতি পেয়ে দ্রুত ওপরের পদে চলে যান। শুধু এমবিবিএস পাস করে যাঁরা মেডিক্যাল অফিসার হয়েছেন, তাঁদের অল্পসংখ্যক ছাড়া অনেকেই জীবনে চাকরির শেষে গিয়ে একটি পদোন্নতি পান। তত দিনে হয়তো কৃষি কিংবা শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করা বিসিএসের একই ব্যাচে অন্যান্য কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদোন্নতি পেয়ে কৃষি কিংবা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হবেন এবং প্রশাসন ক্যাডারের ব্যাচমেট হয়তো সচিব হবেন। সব ক্যাডারের জন্য যদি আর কোনো উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন না হয়, তাহলে স্বাস্থ্য ক্যাডারের জন্য কী কারণে অতিরিক্ত ডিগ্রির প্রয়োজন হবে?

চিকিৎসকদের এই নির্মম বাস্তবতাকে ধারণ করে চাকরি করতে হয়। আমাদের দেশে আজও যাঁরা বেশি মেধাবী, তাঁরাই মেডিক্যাল কলেজে পড়েন। অথচ সবচেয়ে মেধাবীদের প্রতি সবচেয়ে বেশি বৈষম্য করা হচ্ছে। দেশে একমাত্র মেডিক্যাল অফিসার ছাড়া ছোট-বড় অন্য যেকোনো চাকরিতে চাকরিজীবীর পদোন্নতির নিয়ম এতটা কঠিন নয়। এমনও হয়েছে, সারা জীবন মেডিক্যাল অফিসার পদে থেকেই অবসরে যেতে হয়েছে। দেশের আর কোনো কর্মকর্তা কি কখনো যে পদে যোগদান করেন, সেই পদ থেকে অবসরে যান? যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির কথা বলি তাহলে দেখা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে তা অনেকখানি সহজ। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের মাত্র দুই বছর পর, কোনো কোনো বিশ্ববিদালয়ে তিন বছর পর সহকারী অধ্যাপক হন। এখানে পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে নয়, পদোন্নতির সময় হলেই একটি পরীক্ষার মাধ্যমে আপগ্রেডেশনে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ক্যাডারভিত্তিক চাকরিতে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে ক্যাডারদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হতো। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যখন একজন ১৫ বছর ধরে মেডিক্যাল অফিসার পদে চাকরি করেন এবং তাঁর অনেক জুনিয়র প্রশাসন ক্যাডারের একজন তরুণ কর্মকর্তা যখন সেই উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হয়ে আসেন, তখন সেই ইউএনওকে মনে-প্রাণে মেনে নেওয়াটা আর সহজ হয় না। ফলে চাকরির প্রতি বীতশ্রদ্ধ ভাব জন্ম নেয়। এর প্রভাব অনেক নেতিবাচক ফল বয়ে আনে।

স্বাস্থ্য ক্যাডার ও প্রশাসন ব্যবস্থা

মুনতাসীর মামুন এবং জয়ন্তকুমার রায় রচিত “প্রশাসনের অন্দরমহল” শীর্ষক গ্রন্থে সরকারি চাকরিতে স্পেশালিস্ট এবং জেনারালিস্ট নিয়ে অনেক কথা রয়েছে। প্রশাসনের গতিশীলতার জন্য রাষ্ট্রে জেনারালিস্টদের প্রয়োজন আছে। কিন্তু কীভাবে একটি দেশে জেনারালিস্টরা মোটামুটি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে সে বর্ণনাও বইটিতে বিদ্যমান। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগের সবগুলো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদগুলোতে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদচারনা। তারা যে অবৈধভাবে সে পদগুলোতে নিযুক্ত আছেন তা কিন্তু নয়, বরং আইনই তাদেরকে সব জায়গায় শীর্ষ পদের অধিকার দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা পুলিশ বাহিনীর কথা বলতে পারি। এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন একটি প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ, এটি তার কাজের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দায়বদ্ধ। তাদের বেতন-ভাতা সব হয় এই মন্ত্রণালয় থেকেই। এই মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হলেন স্বরাষ্ট্র সচিব যিনি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। ফায়ার সার্ভিস, বর্ডার গার্ড, আনসার ও ভিডিপি, বহির্গমন পাসপোর্ট বিভাগ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, কারা অধিদপ্তর- এসব ক’টি প্রতিষ্ঠান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদ হিসেবে পুলিশ বাহিনীর প্রধান হতে পারেন, একজন কারা কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদ হিসেবে কারা অধিদপ্তরের প্রধান (এটি আবার সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য হয়ে গিয়েছে) হতে পারেন কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা তাদের সবার চেয়ে উপরে অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান অর্থাৎ সচিব হতে পারেন। এক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাদে একই দৃশ্য সব মন্ত্রণালয়ে। একজন চিকিৎসক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হতে পারেন কিন্তু স্বাস্থ্য সচিব হবেন প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বা জেনারালিস্ট। শিক্ষা হোক আর অর্থই হোক- সব মন্ত্রণালয়ের প্রধান একজন সচিব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন জেনারালিস্ট বা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা কি সব বিষয়ে পারদর্শী? তিনি কি সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ? ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা যেমন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধানও হন, জাতীয় জাদুঘরেরও প্রধান হন আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধানও হন। তিনি কি আইন থেকে শুরু করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের মত পুলিশি কাজ, স্বাস্থ্যসেবার মত চিকিৎসকের কাজ বা জাদুঘর পরিচালনার জন্য ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্ববিদ্যার কাজ সবই পারেন? একজন মানুষ এতকিছু কিভাবে পারেন? অনেকেই বলতে পারেন তিনি তো প্রশাসনিক কাজ করেন, আর প্রশাসনিক কাজ তো সব জায়গায় একই। তাহলেপ্রশ্ন, তিনি সব জায়গায় প্রশাসনিক কাজ করতে চান ভাল কথা কিন্তু সব জায়গায় তিনিই কেন সর্বোচ্চ পদের মালিক হবেন? সরকারি সব প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীন। মন্ত্রীর পরে সেই মন্ত্রণালয়ের প্রধাণ হচ্ছেন একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। খুব অল্প ক্ষেত্রে আমরা বিশেষজ্ঞদের মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে দেখেছি।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে একবার উন্নত চিকিৎসার জন্য কোন এক যন্ত্র ক্রয় করা হয়। কোন এক উপলক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় হাসপাতালে আসেন। সেখানে বক্তব্য দেয়ার সময় সদ্য ক্রয়কৃত যন্ত্রটি সম্পর্কেও বলতে হবে। বক্তব্য দেয়ার আগে তিনি চিকিৎসকদের কাছে কোন রোগে উক্ত যন্ত্রটি ব্যবহৃত হয় তা জানতে চান। যেকোনো চিকিৎসকই ঐ যন্ত্র কোন রোগে ব্যবহৃত হয়, কীভাবে কেন ব্যবহৃত হয় বলতে পারেন। কিন্তু সচিব মহোদয় চিকিৎসাবিজ্ঞান তো দূরে থাক, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীও নন। তাকে সেই যন্ত্রের কার্যকারিতা বোঝাতে গিয়ে চিকিৎসকদের খবর হয়ে গেল। এখানে সচিব মহোদয়ের দোষ দেখি না। এটা হল আমাদের সিস্টেমের দোষ।

ডাক্তারদের প্রধাণ যদি প্রশাসন ক্যাডারকে বানানো হয় তাহলে ফলাফল এমনই ঘটবে। প্রশাসনিক কাজ চালানোর জন্য জেনারালিস্টদের দরকার আছে। একেক মন্ত্রণালয়ের একেক কাজ। মন্ত্রণালয়ের সহকারি সচিব, উপ-সচিব বা যুগ্ম- সচিবদের কাজ মূলত ঐ মন্ত্রণালয়াধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, পদন্নোতি, বদলি, পেনশন কিংবা অধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ বরাদ্দ, ফাইল তৈরি ও মেইনটেইন করা, অন্যান্য দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করা ইত্যাদি। কিন্তু প্রশাসনিক পদের কর্মকর্তাদের জন্য কেন সকল মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদগুলো সংরক্ষিত থাকবে? একই যোগ্যতা এবং একই পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করে সাধারণ বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত আরও অনেক ক্যাডারে কর্মকর্তারা নিয়োগ পান। এক পররাষ্ট্র ক্যাডার ব্যতীত আর সব ক্যাডারদের প্রধাণ কেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই হন?

আমাদের দেশ আজ আমলাতন্ত্রের হাতে বন্দী। এই আমলাতন্ত্র উপমহদেশে চালু করে দিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশরা। তারা নিজেদের দেশে এই ব্যবস্থার অনেক সংস্কার সাধন করেছে। আমরা এখনও বের হয়ে আসতে পারি নি এই শোষণমূলক ব্যবস্থা থেকে। ভারতেও আমলাতন্ত্র রয়েছে তবে আমাদের মত হুবহু ব্রিটিশ সিস্টেম তারা ধরে রাখে নি। তারা প্রশাসন, পুলিশ এবং বনের ক্ষেত্রে আলাদা সার্ভিস গঠন করেছে। এক পরীক্ষা দিয়ে সবাইকে নিয়োগ দেয়ার সংস্কৃতি থেকেও তারা বের হয়েছে। সব পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর থেকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা বা আমলাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করেছে অনেকাংশে। কেননা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সুবিধা-অসুবিধা কীভাবে বুঝবেন? তাদের হাতে সব জায়গার ক্ষমতা থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ কি বৃদ্ধি পায় না?

স্বাধীনতার চার যুগের বেশি সময় পরও বাংলাদেশের জনপ্রশাসন এবং আমলাতন্ত্র যুগোপযোগী এবং দক্ষ হয়ে ওঠেনি। এ কারণে প্রশাসনিক সংস্কার বিষয়ে বহুদিন থেকে আলোচনা হচ্ছে। স্বার্থহানির আশঙ্কায় সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ কোনো সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে দেন না বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। বাংলাদেশের জনপ্রশাসনকে গতিশীল এবং উন্নয়নমুখী করতে হলে দ্রুত সংস্কারে হাত দিতে হবে। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার বাদে অন্য সবকয়টি ক্যাডার থেকে উপসচিব পদমর্যাদায় ২৫% নেওয়া হয়। এ কারণে অন্য ২৮টি ক্যাডারের বহু মেধাবী এবং সৎ কর্মকর্তা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে পারেন না। এ কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে যেমন হতাশার সৃষ্টি হয়, তেমনি ক্রমে জনপ্রশাসন মেধাশূন্য হতে থাকে। কোটার ভিত্তিতে অন্য ক্যাডার থেকে আসা অনেক কর্মকর্তা তার নিজের ক্যাডারের পদমর্যাদার নিুস্তর উপসচিব পদে গেলেও পরবর্তী সময়ে প্রশাসনের খুব মর্যাদাস¤পন্ন পদে তাদের নিয়োগ প্রদান করা হয় না।সচিবালয়ের প্রায় সব উর্ধতন পদে শুধুমাত্র প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন করা কি অন্যায্য ও অন্যায় না? ন্যায়ত: উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে সকল ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই সচিব হবার সমান অধিকার থাকার কথা। কিন্ত প্রশাসনের কোটারি স্বার্থবাজরা অন্য ক্যাডারদের সচিবালয়ে প্রবেশের দ্বার প্রায় বন্ধ রেখেছে। এবং অন্যায় ও বৈষম্যমূলকভাবে অন্য সব ক্যাডারের বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, ট্রেনিং, বেতনবৃদ্ধির ভাগ্যবিধাতা রূপে কাজ করে যাচ্ছে।

একজন আমলা একটা বড় সাইজের কেরানি মাত্র। অথচ যে কোন উচ্চমার্গের পেশাদারকেও তার কাছে সকম্পিত থাকতে হয়। সচিবালয়ে কোন আত্মীয় থাকলে বা সচিবালয়ের কাউকে ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করা গেলে একজনের চলার পথ যতটা মসৃণ, তা না হলে তা ততটাই কঠিন। তাদেরভাবসাব, এটিচ্যুড, দেহভাষায় তাই ব্রাহ্মণ্যযভাবটা প্রবল। এ বৈষম্য বড় বেশি বর্ণনবাদী। অন্য ক্যাডাররা যেন বা তাদের দাসানুদাস।

জাতীয় বেতন কাঠামে বৈষম্য

স্বাস্থ্য ক্যাডারসহ বিভিন্ন ক্যাডারকে বঞ্চিত করে আমলাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে অষ্টম বেতন
কাঠামো (পে-স্কেল) অবশেষে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। নতুন এই পে-স্কেল গত ১ জুলাই
থেকে কার্যকর হবে। তবে নতুন বেতন কাঠামোতে থাকছে না টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড।
আর এতে প্রশাসন ক্যাডার (আমলা) সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে। মূলত প্রশাসন ক্যাডারকে প্রাধান্য দিয়েই ‘অষ্টম পে-স্কেল’ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অনেকের মতে এটা ‘আমলাবান্ধব’ পে-স্কেল।’ সিলেকশন গ্রেড বাতিলের মূল কারণ হলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ৫০টি শীর্ষস্থানীয় পদকে পর্যায়ক্রমে প্রশাসন ক্যাডারের অধীনে নেয়া। এসব পদের অধিকাংশেই সিলেকশন গ্রেড পাওয়া সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তারা দায়িত্বপালন করছেন। সিলেকশন গ্রেড বন্ধ হলে শীর্ষস্থানীয় এসব পদে আমলা ছাড়া আর কেউ পদায়ন পাওয়ার সুযোগ পাবে না। ২০১৪ সালে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ৩০টি শীর্ষ পদকে গ্রেড-১ এবং ২০টি পদকে গ্রেড-২ তে উন্নীত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রশাসনে গ্রেড-১ সচিব এবং গ্রেড-২ অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার পদ। এর মধ্যে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ বিভাগে গ্রেড-১ পদ সবচেয়ে বেশি রাখা হয়েছে। অথচ সবচেয়ে বড় ক্যাডার হলো স্বাস্থ্য। দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্যাডার সাধারণ শিক্ষা। আর এই ক্যাডার দুটিতে মাত্র একটি করে গ্রেড-১ পদ।

এমবিবিএস পাস করে সরকারি চাকরিতে মেডিকেল অফিসার পদে যোগদান করেন একজন
চিকিৎসক। চিকিৎসকরা তথা প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তারা বিসিএস এর মাধ্যমে ৯ম গ্রেডে যোগদান করে। ৩০ বছর চাকরির পরও তাদের অনেককে মেডিকেল অফিসার হিসেবেই অবসরে যেতে হয়। উচ্চতর (স্নাতোকোত্তর) ডিগ্রি অর্জন না করলে পদোন্নতি পাওয়া যায়না। কেউ যদি স্নাতোকোত্তর না করতে পারে তাহলে তাকে ৯ম গ্রেডে থেকেই অবসরে যেতে হবে। আবার দিনরাত কষ্ট করে পড়াশুনা করে ডিগ্রি অর্জন করলেও সীমিত সংখ্যক পদ থাকায় যোগ্যতা থাকা স্বত্ত্বেও যথাসময়ে পদোন্নতি পাননা চিকিৎসকরা। যেসব পদ ব্লক পদ হিসেবে গন্য অর্থাৎ পদোন্নতিযোগ্য পদ নেই সেক্ষেত্রে ৯ম গ্রেডের ক্ষেত্রে ৪ বছর সন্তোষজনক চাকুরী ও অন্যান্য শর্তাদি সাপেক্ষে কর্মকর্তারা ৭ম গ্রেডে উন্নীত হয়। ৬ষ্ঠ গ্রেড ও ৫ম গ্রেডের বেলাতেও এভাবে চাকুরীর নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে উচ্চতর গ্রেডে উন্নীত হবার সুযোগ থাকে। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তারা যে গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন, ইনক্রিমেন্ট হতে হতে সে গ্রেডের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছানোর একবছর পর উচ্চতর গ্রেডে উপনীত হতে পারেন। এসুযোগ সমগ্র চাকুরী জীবনে একবার প্রাপ্য।

টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দিলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদটিতে আর হয়ত কোন চিকিৎসক নিয়োগ পেতে পারবেন না ভবিষ্যতে। কারণ পদটি ২য় গ্রেডের। আর সিলেকশন গ্রেড আর টাইম স্কেল না পেলে চিকিৎসকরা হয়তো ২য় গ্রেডে উন্নীতই হতে পারবেন না। প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা সহজেই পদোন্নতি পেয়ে দ্রুততম সময়ে বড় কর্মকর্তা বনে যান। সদ্য ঘোষিত পে-স্কেলে সর্বোচ্চ গ্রেড ১ ও ২ শুধুমাত্র আমলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। অন্যক্যাডারের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রী পরিষদ সচিব নামে আরো দুটি স্কেল শুধু আমলাদের জন্য আগেই নির্ধারিত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ক্যাডারের অধ্যাপকরা গ্রেড-৩ অনুযায়ী বেতন ভাতা ও সুবিধা পান। সিলেকশন গ্রেড পেলে তারা গ্রেড-২ এ উন্নীত হতে পারতেন। কিন্তু সিলেকশন গ্রেড বাতিল হওয়ায় তাদের গ্রেডের উন্নতি বন্ধ হয়ে গেছে। এ ব্যাপারটি যতটা না আর্থিক তার চেয়ে বেশি অবমাননাকর। নতুন পে স্কেলে সিলেকশন গ্রেড বাতিলের ফলে মেডিকেলের অধ্যাপকদের জন্য গ্রেড-৩ সর্বোচ্চ পদ। সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল বন্ধ করায় একই ব্যাচ ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বেতন বৈষম্য বাড়বে এবং ক্ষেত্র বিশেষে অবনমন হবে। কারণ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিজস্ব ক্যাডার তফসিলের নির্ধারিত পদের (লাইন পদে) বাইরে উপসচিব বা তদূর্ধ্ব পর্যায়ের পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এ স্তরে অনুমোদিত পদের চেয়ে অতিরিক্ত সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতির মাধ্যমে উচ্চতর স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার পদ না থাকার অজুহাতে অন্যান্য ক্যাডার ও ফাংশনাল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের বছরের পর বছর একই পদে বসিয়ে রাখা হয়। ফলে একই ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক বেতন বৈষম্য সৃষ্টি হয়। সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের কারণে সৃষ্ট এ বেতন বৈষম্য নিরসনের সুযোগ ছিল। বেতন স্কেলে মূল বেতনের ওপর একটি নির্দিষ্ট হারে প্রতি বছর বেতন বৃদ্ধির সুবিধা দেয়া হয়েছে। যে কর্মকর্তা নিয়মিতভাবে পদোন্নতি পাবেন তিনি এ সুবিধা পাবেন। নিয়মিত পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তা প্রতিটি পদোন্নতিতে উচ্চতর বেতন স্কেলে যাবেন এবং ওই ধাপের মূল বেতনের নির্ধারিত হারে বেতন বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন। অন্যদিকে যে কর্মকর্তার পদোন্নতির সুযোগ নেই তিনি ওই কর্মকর্তার তুলনায় নিচের স্তরের বেতনস্কেলের নিধারিত হারে বেতন বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন। তাই সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল বাতিল করা একটি চরম নৈরাজ্যমূলক সিদ্ধান্ত।
এখন প্রশ্ন উঠবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে তা হলে কে বসবেন? উত্তর হলো যেহেতু মেডিকেল অধ্যাপকরা গ্রেড ৩ আর মহাপরিচালকের পদটি গ্রেড-২, সুতরাং সচিবালয় থেকে গ্রেড-২ মানের অতিরিক্ত সচিব আমদানি করা হবে। কৃষি, প্রকৌশলী ও অন্য সব সেক্টরেও একই কাহিনী। এখন যারা সিলেকশন গ্রেড প্রাপ্ত সিনিয়র অধ্যাপক, কৃষিবিদ, প্রকৌশলী আছেন তারা একে একে অবসরে যাবার পর নিজেদের দপ্তর অধিদপ্তরে আমলা ছাড়া আর কাউকে দিয়ে বড় পদগুলো পূরণ করার আর কোন পথ থাকবেনা।

টাইমস্কেল এবং সিলেকশন গ্রেড কী ?

টাইমস্কেল (উচ্চতর বেতন স্কেল) বলতে একই পদে উচ্চতর বেতন স্কেলকে বোঝায়। পদোন্নতির
যোগ্য অথচ শূন্য পদের অভাবে পদোন্নতি দেয়া যাচ্ছে না এমন কর্মচারী এবং জুনিয়র ও মধ্যম স্তরের কর্মকর্তাদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রবর্তন করা হয় টাইমস্কেল। ১৯৮১ সালে প্রবর্তিত এ পদ্ধতি প্রথমত ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হয়। এতে অন্যান্য সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলে সরকার ১৯৮৪ সালে সব শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এ পদ্ধতির সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বর্তমানে নন-গেজেটেড কর্মচারীদের একই বা পর¯পর বদলিযোগ্য পদে ৮, ১২ ও ১৫ বছরপূর্তিতে তাদের চাকরির সন্তোষজনক রেকর্ডের ভিত্তিতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় টাইমস্কেল প্রদানের বিধান রয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা এবং প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তাদের জুনিয়র ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে টাইমস্কেল প্রদানের বিধান রয়েছে। তবে জাতীয় বেতন স্কেলের চতুর্থ স্কেলের ঊর্ধ্বের কোনো কর্মকর্তা টাইমস্কেল পাবেন না।
অনুরূপভাবে পদ না থাকা বা ভিন্ন কোনো কারণে একই স্কেলে দীর্ঘদিনের সন্তোষজনক চাকরির পর অনেকে পদোন্নতি পান না। এ ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি নির্ধারিত অংশকে কতিপয় শর্তপূরণ সাপেক্ষে উচ্চতর স্কেল প্রদান করা হয়, যা সিলেকশন গ্রেড নামে পরিচিত। এটি সত্তর দশকে প্রবর্তন করা হয়।

টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দেবার পক্ষে সরকারের যুক্তি

নতুন বেতন স্কেলে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দেয়া
হয়েছে। তবে তাদের মূল বেতনের ওপর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। ২০ থেকে ষষ্ঠ গ্রেড পর্যন্ত বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হবে মূল বেতনের ৫ শতাংশ। পঞ্চম গ্রেডে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৪ শতাংশ। তিন ও চার নম্বর গ্রেডে প্রবৃদ্ধি হবে ৪ শতাংশ। গ্রেড দুই-এর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে এক নম্বর গ্রেডে কোন প্রবৃদ্ধি হবে না বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেওয়ার পক্ষে ১২টি যুক্তি তুলে ধরে অর্থ বিভাগের তৈরি করা
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লোকসানের চেয়ে বরং লাভই হবে। নতুন বেতন কাঠামোতে টাইম স্কেল বহাল থাকলে ২০ নম্বর গ্রেডের একজন কর্মচারী চাকরির আট বছর পূর্তিতে ১১,৩৮০ টাকা, ১২ বছর পূর্তিতে ১৩,৩৬০ টাকা ও ১৫ বছর পূর্তিতে ১৫,১৫০ টাকা বেতন পেতেন। এখন তিনি প্রতিবছর টাইম স্কেল বাদ দিয়ে ৫ শতাংশ হারে চক্রবৃদ্ধি ইনক্রিমেন্ট পাবেন। এতে আট বছর পর ২০ নম্বর গ্রেডভুক্ত ওই কর্মচারীর বেতন হবে ১২,২৪০ টাকা, ১২ বছর পূর্তিতে ১৪,৯০০ টাকা ও ১৫ বছর পূর্তিতে ১৭,২৭০ টাকা। অর্থাৎ টাইম স্কেল বাদ দেওয়ায় তিনি আখেরে লাভবানই হবেন। এ হিসাব তুলে ধরে অর্থ বিভাগ বলছে, যাঁরা ব্লক পদে চাকরিরত তাঁরাও স্বীয় স্কেলে এই ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক সুবিধা পাবেন, যা জটিল টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড থেকে সহজলভ্য।

চিকিৎসকদের দাবী

চিকিৎসকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ঘোষণা, সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহালের দাবিতে ইতিমধ্যে রাজপথে আন্দোলনে নেমেছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকদের দাবিগুলো হলো-সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল, স্বাস্থ্য ক্যাডারে চাকরির বয়স অনুযায়ী অন্যান্য ক্যাডারের মতো নতুন পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতির ব্যবস্থা, সকল বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মকর্তার পদ মর্যাদা একই রকম করা, সকল ক্যাডারকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ প্রদান ও উপজেলা কর্মকর্তার বেতন বিলে ইউএনওর সাক্ষরের সিদ্ধান্ত বাতিল করা।

যা যা করা প্রয়োজন
প্রত্যেক কর্মকর্তার স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদ অর্থাৎ সচিব পদ পর্যন্ত যাওয়ার প্রস্তাব
করে প্রশাসনিক সংস্কার করা যেতে পারে। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা পদোন্নতির মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন এবং এখানে অন্য কোনো ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ আসতে পারবেন না- এভাবে ক্যাডার বিন্যাস করা যেতে পারে।

জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রশাসনিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল
বাংলাদেশ এবং ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন করতে হলে বর্তমান প্রশাসন কাঠামো রেখে তা সম্ভব নয়। কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমলাদের কারণে সরকারের সফলতা মার খাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তার আশঙ্কা অমূলক নয়। যুগোপযোগী, সেবার মনোভাবাপন্ন,
ইনফরমেশনটেকনোলজির সঙ্গে সুপরিচিত, দক্ষ এবং উন্নয়নমুখী জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে না পারলে কাংক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হবে না।

বিসিএস পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে একজন স্নাতক সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ পান।
পদমর্যাদায় একই হলেও অনেক প্রশাসনিক এবং সরকারী সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হন।
প্রশাসন কিংবা প্রশাসন সহযোগী ক্যাডার গুলোতে তারা যেসব সুবিধা ভোগ করেন কিংবা শিক্ষকরা যে পরিমাণ সম্মান লাভ করেন চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে তা পুরোপরি কখনই পান না। অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে এবং জনবলের অভাবে থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যথাযথ সেবা প্রদান সম্ভব হয় না। সেখানে চিকিৎসক একজন “ঢাল তলোয়ার বিহীন একজন নিধিরাম সর্দার” ফলে জরুরী চিকিৎসা সেবার অভাবে রোগীর করুণ পরিণতির দায়ভার বর্তায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের প্রতি। চিকিৎসকদের নিয়োগের এই পদ্ধতির কিছুটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। গঠন করা দরকার আলাদা সার্ভিস কমিশন অর্থ্যাৎ স্বাস্থ্যসেবা কমিশন।

চিকিৎসকদের পদোন্নতি নীতিমালা অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রণয়ন করা
দরকার। একই সঙ্গে পদ শূন্য না থাকলেও পদোন্নতি প্রক্রিয়া চালু হওয়া প্রয়োজন। তবে পদ শূন্য হওয়া সাপেক্ষে পদায়ন হবে। পদোন্নতির জন্য যোগ্য প্রার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া সাপেক্ষে পদোন্নতির বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ক্যাডারের দুরবস্থা দূর করতে হলে মেধাবীদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। চিকিৎসকরা দিনের পর দিন যদি অবহেলিত থাকেন, তাহলে একদিন মেধাবীরা আর চিকিৎসাবিজ্ঞানে লেখাপড়া করতে আগ্রহী হবেন না। তাঁদের কর্মজীবনে স্বস্তি না ফিরলে তাঁরা শুধু অর্থকেই মানসম্মান পরিমাপের মানদণ্ড মনে করবেন, যার প্রভাব শুধু নেতিবাচক ফল ছাড়া অন্য কিছুই বয়ে আনবে না।

যেহেতু চিকিৎসকদের ক্রমাগত পেশাগত উন্নতির জন্য স্নাতোকোত্তর প্রশিক্ষণ অত্যাবশ্যক
সেহেতু এই পেশায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের কে সেই রকম যথাযথ সুযোগ দেওয়া প্রযোজন। শুধু তাই নয় বিশেষজ্ঞ তৈরি করার পর থানা পর্যায়ে যাতে বিশেষায়িত সেবা সুলভ করা যায় সে জন্য
প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন।

সাধারণ ক্যাডারের পাশাপাশি বিভিন্ন টেকনিক্যাল ক্যাডারের ক্ষেত্রে একই প্রশ্নপত্রে
বিসিএস এর নির্বাচনী এবং একই প্রশ্নপত্রে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়, যা অমূলক। প্রতিটি
টেকনিক্যাল ক্যাডার সার্ভিসের জন্য বিশেষায়িত নির্বাচনী এবং লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

স্বতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আকর্ষণীয় বেতন কাঠামো তৈরি করা। যাতে
করে এই পেশা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের তাদের নিজ কর্মক্ষেত্রে আগ্রহ সৃষ্টি করা।

স্নাতোকোত্তর প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক সিট বাড়ানো।

অবকাঠামোগত সংস্কার সাধন। ইউনিয়ন সাব সেন্টার পর্যন্ত জনবল, সহায়ক যন্ত্রপাতি
এবং ওষুধ সুলভ করা।

Courtesy: Abu Imran

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *