কম্পিউটার এখন আমাদের অফিস থেকে শুরু করে ঘরে,আড্ডায় এবং পকেটে চলে এসেছে। তাই তো এখনকার সময়ে কম বেশি সব কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের কাজের সুবিধার জন্য দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস। কম্পিউটার থেকে শুরু করে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব দেওয়া হচ্ছে এখন অফিস থেকে। সিকিউরিটির জন্য এই সব ডিভাইস দেওয়ার সময় অফিসের আইটি ডিপার্টমেন্ট থেকে ডিভাইসের সাথে সাথে লগ ইন,বাছাই করা কিছু অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে দেওয়া হয় তিন চার দিনের মাথায় ডিভাইসটিতে আপনার ব্যক্তিগত ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। নিজেদের পছন্দ মতো অ্যাপ নামান, ওয়ালপেপার বদলান, সোশ্যাল সাইটের লগ ইন কিংবা অন্যান্য ব্যক্তিগত ডাটা জমা হতে শুরু করে কর্মক্ষেত্রের ডিভাইসে। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক এক্সপার্টরা বলেন, আপনাদের এই ব্যক্তিগত ডাটা এবং প্রফেশনাল কাজ কর্ম গুলিয়ে গেলে যেমন আপনার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় ঠিক তেমনি কোম্পানির।

সফটওয়্যার টেকনোলোজি কোম্পানি ‘চেক পয়েন্ট’ ৭০০ আইটি কর্মীদের মাঝে চালায় এক সমীক্ষা। সমীক্ষার ফলাফল শুনলে আপনিও অবাক হবেন। তিন ভাগের দুই ভাগ কর্মী বিশ্বাস করেন কর্মীদের ব্যক্তিগত তথ্যের সাথে প্রফেশনার জগত মিলিয়ে ফেলার কারণে কোম্পানির সবচেয়ে বড় বড় আইটি এবং সিকিউরিটির সমস্যা তৈরি হয়। ‘চেক পয়েন্ট’ এর বরাত দিয়ে আরো বলা হয় “আপনার কোম্পানির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার মূল কারণ আপনার কোম্পানির ভিতরেই থাকে!”

কর্মক্ষেত্রে ল্যাপটপট্যাবলেটের মতো ডিভাইস দেওয়ার সময় বলে দেওয়া হয় অপ্রয়োজনীয় কাজে বা সাইটে না যেতে তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা তারপরও আমরা নিজের ডিভাইস ভেবে ব্যবহার শুরু করি। আপনি ভাবলে অবাক হবেন নিষেধের পরেও অনেকেই নিষিদ্ধ সব সাইটেও ঢুঁ মারেন অফিসের ডিভাইস থেকে। কোন ছয়টা কাজ অফিসের ডিভাইসে করা উচিৎ না? নোট করে রাখুন কিংবা এই ৬টি টিপস বুকমার্ক করে রাখতে ভুলবেন না।

১. অফিসের ডিভাইসে পাসওয়ার্ড সেভ করবেন না

আমাদের কর্মক্ষেত্রের কম্পিউটারের সাথে আমাদের প্রতিদিন ৮/৯ ঘণ্টা থাকতেই হয়, অনেকে তো বাসায়ও একই ডিভাইস ব্যবহার করেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্ট্যাটাস দেয়া থেকে শুরু করে মেসেজিং হয় এই কাজের কম্পিউটার থেকে। বার বার পাসওয়ার্ড দেবার ঝামেলা এড়াতে তাই সেভ করেন পাসওয়ার্ড, কিন্তু নিজেই জানেন না নিজের অজান্তে আপনি নিজের এবং কোম্পানির কত বড় ক্ষতি করছেন।

সোসাইটি অফ হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এর নীতিমালায় বলা হয়েছে,

কোম্পানি প্রদত্ত ইমেইল বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি কারো ব্যক্তিগত কিংবা লুকানোর ব্যাপার নয়, এর সবকিছুই উক্ত কোম্পানির সম্পদ। তাই কোম্পানির রয়েছে তাদের সকল তথ্যডিভাইসনেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণপর্যবেক্ষণের অধিকার। ”

অফিসের কম্পিউটারে পাসওয়ার্ড সেভ না করে কি চেইন সেভার ব্যবহার করুন; Image Source: Life wire

তাই একবার হলেও আপনার কোম্পানির নিয়ম নীতিগুলো পড়ুন। কেননা আপনি যখনই আপনার ডিভাইসে পাসওয়ার্ড সেভ করে রাখবেন তখনই আপনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

২. অফিসের মেসেজিং চ্যাটে অযথা এবং অশ্লীল কৌতুক করবেন না

এখনকার অফিসে টিম মেম্বারদের মাঝে যোগাযোগের জন্য অনেক ধরনের চ্যাট সার্ভিস ব্যবহার করা হচ্ছে। টেলিগ্রাম, স্কাইপ থেকে শুরু করে হাল আমলের স্ল্যাক, ক্যাম্পফায়ার কিংবা গুগল হ্যাংআউট বেশ জনপ্রিয়। কাজের সময় নিজেদের মাঝে কথা বলার জন্য আমরা যেমন এই চ্যাট ব্যবহার করি তেমনি অফিসের ফাঁকে আড্ডাও হয় এই চ্যাট সেশনে। সেখানে কফির অর্ডার ছাড়াও আপনার পাশের কেবিনেটের সহকর্মীর গোপন কথাও লেখা হয় চ্যাটবক্সে। তবে একটি বিষয় মাথায় রাখবেন যে এই চ্যাটগুলো অফিসের সার্ভারে কিন্তু ঠিকই জমা হচ্ছে। আপনার বস কিংবা অফিসের ম্যানেজারের চোখে পড়তে কতক্ষণ!

অফিসের দরকারি চ্যাট সার্ভিসে সাবধান থাকবেন; Image Source: Live enterprise

এই যেমন স্ল্যাক এর কর্ণধার ‘ফাস্ট কোম্পানিকে’ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন-

“স্ল্যাকের রয়েছে আপনার সব চ্যাটের উপর নজরদারি। তাই আপনার চ্যাট সার্ভিস খুব সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা উচিৎ কেননা আমাদের প্রথম প্রাধান্য আমাদের ক্লায়েন্ট কোম্পানির নিরাপত্তা দেওয়া। তাই কোম্পানির সমূহ ক্ষতির কিছু দেখলেই আমরা দ্রুত উক্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করি।”

৩. গুরুত্বপূর্ণ এবং গোপনীয় কাজ কখনোই ফ্রি ওয়াই-ফাই জোনে বসে করবেন না

আমরা অনেকেই হয়তো ঘরে বসে বা বাইরেও কাজ করছেন। আবার অনেকেই হয়তো বাইরের কফি শপে বসে জরুরী মেইল পাঠানোর কাজ সেরে ফেলতে চান। আর এখন তো বিভিন্ন পাবলিক প্লেস যেমন বাসস্ট্যান্ডট্রেনষ্টেশনপার্ককফিশপেরেস্টুরেন্টে দেওয়া হচ্ছে ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধা। এই ফ্রি জিনিসের প্রতি আমাদের রয়েছে আবার বিশেষ আকর্ষণ। তাই ফ্রি ওয়াই-ফাই পেলে আমরা একবার হলেও ফেসবুক নিউজফিড কিংবা মেসেজ বক্স ঘুরে আসি। আপনি বুদ্ধিমান হলে শুধু ইমেইল পাঠানোতে সীমাবদ্ধ থাকবেন। কিন্তু এতেও রক্ষা হবে না, ফ্রি ওয়াই-ফাই জোনগুলোতে আপনার ব্যক্তিগত ডাটা চুরির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কেননা ফ্রি ওয়াই-ফাই জোন হচ্ছে হ্যাকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের আইটি দুষ্কৃতিকারীদের আখড়া। তাই কোম্পানির নিরাপত্তার পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য ফ্রি ওয়াই-ফাইতে লগ ইন রেজিস্ট্রেশন কিংবা ব্যাংক কার্ড ব্যবহার কখনোই করবেন না।

ফ্রি জিনিস সব সময় ভালো না কিন্তু; Image Source: zeta sky

৪. আপনার কাজের ডিভাইসে বন্ধু কিংবা বাইরের লোকদের ব্যবহার করতে দেবেন না

এখন চাইলেও একজন আরেকজনের যন্ত্রে বসে কাজ করতে পারে। সেটি হতে পারে সরাসরি কিংবা হাজার মাইল দূরে বসেও। টিম ভিউয়ার কিংবা স্কাইপি দিয়ে এখন হাজার মাইল দূরে বসেও একজন আরেকজনের যন্ত্রে কাজ করতে পারেকরতে পারে নিয়ন্ত্রণ। তাই আপনি যদি আপনার ডিভাইস আপনার কোন বন্ধু কিংবা ননটেকনিক্যাল কাউকে ব্যবহার করতে দেন তাহলে তারা তাদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করতে গিয়ে সমস্যা বাঁধিয়ে ফেলতে পারে। এছাড়া একজনের ডিভাইস থেকে আরেকজনের স্ট্যাটাসমেসেজ দেওয়ার ঘটনা পুরনো নয়, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আপনি।

আপনার কম্পিটারে যেন বন্ধুদের হাত না পরে; Image Source: wired.com

৫. অফিসের কাজের ডিভাইসে কোনো ব্যক্তিগত তথ্য রাখবেন না

অফিস থেকে কম্পিউটার পাবার কিছুদিনের মাঝেই আমরা আমাদের নিজেদের মতো করে বদলাতে শুরু করি কম্পিউটার। তাই তো কিছুদিনের মাঝেই অফিসের ডেক্সটপে তৈরি হয় নিজের ব্যক্তিগত ফোল্ডার। সেই ব্যক্তিগত ফোল্ডারে ব্যক্তিগত ছবিগান সবই জমা হতে থাকে। তবে একটি ব্যাপার মনে রাখা উচিত ডিভাইসটি কোম্পানির নিজস্ব সম্পত্তি।

ফাউন্ডার অ্যাভিনিঊ এক্স গ্রুপের কর্ণধার জো রেজেস্কি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরছি তিনি বলেন-

আমি একটি কোম্পানির কথা জানি যাদের হুট করেই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, সাথে সাথে তাদের কর্মীদের মাঝে প্রশ্ন ওঠে অফিসের কম্পিউটারে থাকা আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যের (যেমন ট্যাক্স রিটার্ন) কী হবে, আমরা কি কিছুক্ষণের জন্য নিজেদের ডিভাইস ব্যবহার করতে পারি না! কোম্পানি সব যন্ত্রপাতি ইতোমধ্যে সরিয়ে ফেলেছে, কেননা কর্মীর তথ্যের নিরাপত্তা কোম্পানির দায়িত্বের মাঝে পড়ে নি। পরে সেই সব তথ্যের আদৌ কোনো সুরাহা হয়নি কিংবা কি করা হয়েছিল কর্মীদের ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে তাও জানা যায়নি।”

অফিসের ডেস্কটপে নিজের কিছু সেভ করবেননা; Image Source: common.wikimedia.com

আরেকটি বিষয় সকলের জেনে রাখা দরকার যে, আপনি যখনই চাকরি থেকে ইস্তাফা দিচ্ছেন কিংবা চাকরি থেকে বাদ পড়ছেন ঠিক তখনই আপনার অফিসের ডিভাইসের উপর দায়িত্ব এবং অধিকার শেষ। আপনি আপনার ব্যক্তিগত তথ্য সরিয়ে ফেলার সুযোগও পাবেন না। তাই দিনের তথ্য দিনেই সরিয়ে নিন আপনার পেন্ড্রাইভে কিংবা আপনার স্মার্ট ফোনে নিয়ে নিন।

৬. অফিসের কম্পিউটারে আপনার পাশাপাশি চলমান কাজ করবেন না 

আমরা অনেকেই একটি চাকরির পাশাপাশি পার্ট টাইম কাজ করি অতিরিক্ত হাত খরচের জন্য। কেউবা নিজের শখ কিংবা পড়াশুনার কাজটাও অফিসের কম্পিউটারে বসে সারতে চান। আগেই বলা হয়েছে যে, অফিসের কম্পিউটারে বা নেটওয়ার্কে করা সব কাজই জমা হতে থাকে অফিসের সার্ভারে নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যবেক্ষণের জন্য। তাই ম্যানেজার কিংবা নিয়োগকর্তার চোখে পড়তেই পারে। আপাতদৃষ্টিতে খুব সমস্যা মনে না হলেও আপনি যে বসের কুনজরে পড়বেন না তা কিন্তু নয়। তাই নিজেকে সংযত রাখুন আর খুব বেশি দরকার হলে নিজের স্মার্টফোন দিয়ে কাজ সারুন। আপনার আশেপাশে কর্মীরা যাই করুক না কেন আপনি নিজেকে সংযত রাখুন। দেখবেন আপনি বরং বসের সুনজরে থাকবেন।

অফিসের সময় অফিসের কাজ করুন; Image Source: Shutter Stock

এখন যুদ্ধ বলতে সাইবার বা ইন্টারনেটে যুদ্ধ বোঝায়। এখন মানুষের নিরাপত্তা বলতে সাইবার নিরাপত্তা বোঝায়। আপনার অনলাইন তথ্য চুরি হয়ে গেলে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বেন আপনি। আমাদের দেশে সামান্য সিম দিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে কত লোক বিপদে পড়ছে তার ইয়ত্তা নেই, তাই কর্মক্ষেত্রে নিজের তথ্য সাবধানে রাখুন এবং কোম্পানির ক্ষতির চ্যাপ্টার থেকে গা বাঁচিয়ে চলুন। কোম্পানি আপনাকে নচেৎ ছাড়ছে না!