সিআইএর কুখ্যাত এবং ব্যর্থ যত অপারেশন

Source: CIA

হলিউডের মুভির বদৌলতে আমেরিকান সিআইএর নাম আমরা সবাই শুনেছি। সিআইএর পূর্ণরূপ হচ্ছে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি। বর্তমানে প্রায় বিশ হাজারের বেশি এজেন্ট নিয়ে এই ইন্টেলিজেন্স সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়েছিলো ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। নিজের দেশের প্রতিরক্ষা ছাড়াও কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এবং এসপিওনাজের কাজও এই সংগঠনটি করে থাকে। এছাড়া অন্যান্য দেশের আক্রমণের নীলনকশা তৈরিতেও রয়েছে এই সংগঠনের হাত।

সিনেমায় সিআইএর রূপ সুদর্শনা হলেও এই সংগঠনটি বিশ্বের অনেক কুখ্যাত অপারেশনের সাথে জড়িত ছিলো। যদিও সব ঘটনা জনসাধারণের কাছে প্রকাশ পায়নি। তবে যেসব সত্য জনসাধারণের কাছে প্রকাশিত হয়েছিলো সেগুলো নিয়ে আমাদের আজকের এই ফিচার।

Source: American Vagabond

১. অপারেশন মার্লিন

১৯৯৬ সালের ঘটনা। সবমাত্র তখন ইরানে পারমাণবিক গবেষণা শুরু হয়। যার জন্য খোদ আমেরিকার সরকার থেকে শুরু হয়ে সামরিক বাহিনী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আর দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তি মিলাতে সিআইএ তখনকার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের কাজে একটি প্রস্তাবনা নিয়ে হাজির হয়। আর তার নামকরণ করা হয় অপারেশন মার্লিন নামে।

এই প্রজেক্টের মূল উদ্যেশ্য ছিলো ইরানের গবেষকদের কাছে ভুলভাল তথ্য প্রদান করে তাদের গবেষণায় ক্ষতি করার। পরিকল্পনা অনুযায়ী সিআইএ পাঁচ হাজার ডলার বেতন ধার্য করে ১৯৯৭ সালে একজন রাশিয়ান বিজ্ঞানী নিয়োগ দেন। আর পারমানবিক গবেষণার সত্যিকারের তথ্য পরিবর্তন করে সুক্ষ্ম ভুলভর্তি তথ্য তার হাতে প্রদান করেন। বলাবাহুল্য ইরানের গবেষনাগারে তথ্য পাচারের উদ্দেশ্য তারা রাশিয়ান বিজ্ঞানীকে নিযুক্ত করেছিলো।

সবকিছু কিছু ভালোভাবেই চলছিলো কিন্তু বিপত্তি বাঁধে যখন রাশিয়ান বিজ্ঞানী সিআইএর দেওয়া তথ্যের ভুল ধরতে পারেন। সেটা ছিলো ২০০০ সনের ঘটনা। তখন রাশিয়ান বিজ্ঞানীর মাধ্যমে সিআইএর টিবিএ – ৪৮০ ফায়ার সেটের পারমানবিক অস্ত্র পাচার করছিলো। সিআইএ দাবি ছিলো তাদের দেওয়া এই প্রযুক্তি সেসময়ের থেকে কমপক্ষে ২০ বছরের প্রযুক্তিতে এগিয়ে রয়েছে। আসলে বাস্তবেও ছিলো তাই। কিন্তু সিআইএ তথ্যের হেরফেরের কথা রাশিয়ান বিজ্ঞানীর কাছে গোপন রেখেছিলেন। ফলে ভুল ধরার পর রাশিয়ান বিজ্ঞানী ইরানি বিজ্ঞানীদের জানান, যেটা সিআইএদের অপারেশনে ব্যাকফায়ার করে বসে। পরবর্তীতে ইরানি বিজ্ঞানীরা সিআইএর দেওয়া পারমানবিক প্রযুক্তি নিয়ে ভালোভাবে গবেষণা করে সংশোধন করে নেয়।

২. বে অফ পিগস

১৯৫৯ সনের ঘটনা। রাস্ট্রপতি এবং একনায়ক মিলিটারী সম্রাট জেনারেল ফুলফেনসিও বাতিস্তাকে হটিয়ে যখন ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিউবায় ক্ষমতায় অধিগ্রহণ করেন তখন আমেরিকান স্নায়ুযুদ্ধের যোদ্ধা আতকে ওঠে। কারন বাতিস্তা তখন আমেরিকার মিত্র দেশের মধ্যে একটি ছিলো আর কিউবাতে আমেরিকা বিপুল পরিমান অর্থ বিনিয়োগ করেছিলো। নিজেদের স্বার্থে আঘাত হানার ফলে, সেবছরই কিউবায় অপারেশনের জন্য সিআইএর হাতে দায়িত্ব প্রদান করলেন তখনকার রাস্ট্রপতি ডুয়াইট ডি. আইসেনহাওয়ার। বছর পার হতে ১৯৬০ সালে যখন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি নির্বাচিত হলেন, তখন তিনি আইসেনহাওয়ারের পরিকল্পনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন।

Source: CIA

সিআইএ বিগ্রেড ২৫০৬ নামে একটি প্যারামিলিটারি গ্রুপ গঠন করে। যার সৈন্যরা মূলত ছিলো বাতিস্তা পন্থী কিউবান সদস্যরা। তবে বেশ কিছু আমেরিকান মিলিটারি সৈন্যরাও এই বাহিনীর যোগ দিয়েছিলো। পরিকল্পনা ছিলো বিগ্রেড ২৫০৬ এর এলিট ফোর্স এয়ারফোর্সের সহায়তা নিয়ে স্থলভাগে আক্রমণ চালাবে এবং কিউবা দখল আর ক্যাস্ট্রোকে হত্যার পর হোসে মিরো কার্ডোনাকে বানানো হবে সেদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট। পরিকল্পনা অনুযায়ি ১৯৬১ সনের ১৭ এপ্রিল প্রথম আকাশপথে আক্রমণ চালানো হয়।

তবে ফিদেল ক্যাস্ট্রো সিআইএর এই তথাকথিত গোপন অপারেশন কথা আরো আগে থেকেই জানতেন, তাই তার সেনাবাহিনী ছিলো এজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। আকাশপথের আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার ২ দিন পর ব্রিগেড ২৫০৬ এর প্রায় ১৪০০ সৈন্য কিউবার সমুদ্রসৈকত বে অফ পিগসে এসে পৌছায়। ক্যাস্ট্রোর আর্মি আক্রমণের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকায় বিগ্রেড ২৫০৬ সৈন্যদের দূর্দশার অন্ত ছিলো না। দুই দিন দুইপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলে আর আক্রমণকারীরা প্রথমদিনেই একশত এর বেশি সৈন্য হারায়। পরে কোন সুবিধা না করতে পেরে দুইদিনের মাথায় ১২০০ সৈন্য কিউবার সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

কিছুদিন পর কিউবান সরকার বাচ্চাদের খাদ্য আর ওষুধের বিনিময়ে যুদ্ধবন্দীদের আমেরিকার সরকারের কাছে হস্তান্তর করে।

৩. অপারেশন মনোগুজ / কিউবান প্রজেক্ট

বে অফ পিগসের অপারেশন ব্যর্থ হওয়ার পরের ঘটনা। কিউবার কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয়ের ফলে রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির মানসম্মানের বেহাল দশা। এই ব্যর্থতার জন্য জন কেনেডি এতটাই রাগান্বিত হয়েছিলেন যে তিনি বলেই বসেছিলেন, “আমি সিআইএকে ভেঙেচুরে হাজার হাজার টুকরো করবো আর সেগুলো ফু দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিবো”। তবে এবার তার সিআইএ উপর বিন্দুমাত্র ভরসা ছিলো না। তাই জন কেনেডি তার একমাত্র বিশ্বস্ত মানুষ তার ভাই রবার্ট কেনেডির কাছে সরনাপন্ন হলেন।

Source: CIA

রবার্ট কেনেডি ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স আর সিআইএ কে নিয়ে নিজের তত্বাবধায়নে এই অপারেশনটি দাঁড়া করালেন। নামকরণ করা হলো অপারেশন মনোগুজ। এর প্রথম এবং দ্বিতীয় উদ্যেশ্যে একটাই ছিলো। ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে মরতে হবে। যতদ্রুত সম্ভব, অর্থ কোন বিষয় নয় এখানে। ক্যাস্ট্রোকে হত্যা করার উদ্যেশ্যে কয়েক ডজন প্রচেষ্টা চালানো হয়। তার মধ্যে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের জেসম বন্ডের মত বেশ কিছু মিশনের প্রচেষ্টাও ছিলো। তখনকার সিআইএর প্রধান এলেন ড্যুলেস ছিলেন জেমস বন্ডের ভক্ত। বইয়ে জেমসবন্ডের অত্যাধুনিক গিয়ারের মত তিনি আধুনিক যন্ত্রপাতি তৈরি করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন শুধুমাত্র এই অপারেশন সফল করার উদ্যেশ্য।

ক্যাস্ট্রোকে হত্যার জন্য তখন সিআইএ মরিয়া হয়ে উঠেছিলো। ছয় জনের দশ সদস্যের দল তারা কিউবাতে গোপনে পাঠায়। আর ম্যাফিয়া হিটম্যান জন রোসিলি থেকে শুরু করে, ইউরোপীয়ান প্রফেশনাল হিটম্যান তারা ভাড়া করে। এসব প্রচেষ্টা পাশাপাশি বিষাক্ত ওষুধ, সিগারেটের মধ্যে বিস্ফোরক দিয়ে হত্যার মতো উদ্ভট পরিকল্পনাও তারা করেছিলো।

এছাড়া ফিদেল ক্যাস্ট্রোর স্কুবা ড্রাইভিং স্যুটে মরণঘাতী জীবানু স্থাপন, স্কুবা ড্রাইভিংয়ের স্থানে বোম্বিং করার প্রচেষ্টা করা হয়। বলা চলে তাকে হত্যার জন্য ঘায়ে কুত্তা দশা হয়েছিলো সিআইএর। তাদের পাগলামি এমন পর্যায়ে পৌছে ছিলো ক্যাস্ট্রোর জুতোয় তারা থেলিয়াম লবণের গুঁড়া প্রতিস্থাপনের চেষ্টাও চালিয়েছিলো। হত্যা করা সম্ভব না হলেও যেন ক্যাস্ট্রোর দাড়ি ঝড়ে পড়ে আর জনসম্মুখে সে অপমানিত হয় এটা ছিলো সিআইএর আশা।

Source: getty Images

তবে তাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বডিগাড একবার বলেছিলো, “সিআইএ ক্যাস্ট্রোকে হত্যা করার জন্য একশতর উপরে বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালায়। যার প্রতিটিতে তারা ব্যর্থ হয়েছিলো”। সিআইএর বিশাল পরিমাণ অর্থ অপচয় আর সকল প্রচেষ্টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ৪৯ বছর কিউবায় রাজত্ব করেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। আর স্বাস্থ্যের দূর্বলতার কারণে ২০০৮ সালে তার ভাইয়ের হাতে তার দায়িত্ব সমার্পণ করে অবসর নেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *