আকাশপট নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। আকাশে কত কী ঘটে চলছে হরহামেশাই, কেন হচ্ছে? কিভাবে হচ্ছে? এ নিয়ে জানবার ইচ্ছা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। এই মানুষদের ভিড়ে আকাশপট নিয়ে তথা জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আকৃষ্ট পোষণকারী অন্যতম এক মানুষ হচ্ছে জোহানেস কেপলার। বলা হয়ে থাকে, কোপারনিকাসের ভূ-ভ্রমণ বাদে যে সমস্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রচন্ড আগ্রহ দেখিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কেপলারই উল্লেখযোগ্য। তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক বিশিষ্ট এই জ্যোতির্বিজ্ঞানীর জীবনপথের আদ্যোপান্ত।

১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির ওয়েল নামক একটি শহরে জোহানেস কেপলার জন্মগ্রহণ করেন। খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন কেপলার। তার পিতার প্রায়শই তেল আনতে নুন ফুরনো অবস্থায় জীবন চলতো। তার উপর কেপলার ছোটোবেলা থেকেই ছিলেন রোগা এবং শান্ত। রোগের ভয়ে তার বাবা তাকে স্কুলে পাঠানোর মতো ইচ্ছাই দেখাননি। তার বাবা ভাবতেন- তিনবেলা খাবার জুটানো কষ্টসাধ্য অন্যদিকে রোগা দেহ নিয়ে পড়ালেখা দুঃসাধ্য বটেই।

তার বাবা নিজেই কেপলারকে ঘরে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি দেন। কিন্তু মনের টান যার প্রকট তাকে ঠেকাবার সাধ্য কার? কেপলারের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ ছিলো প্রচণ্ড। অজানাকে জানার আগ্রহ তার চেয়েও ভয়ানক। কিন্তু তার আগ্রহকে বাস্তবে রুপ দেবার চিরতার্থ করার সামর্থ্য তার বাবার ছিলো না। তাই তার বাবা বাধ্য হয়েই বেশি বয়সে স্থানীয় এক অবৈতনিক বিদ্যালয়ে কেপলারকে প্রেরণ করে। এর মধ্যে বলে রাখা ভালো কেপলারদের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিলো যে, কেপলারকে সরাইখানায় কাজ নিতে হয়েছিলো।

ছবিসূত্র:arminius1871.deviantart.com

কেপলার ছোটোবেলা থেকেই ছিলেন প্রচন্ড মনযোগী এবং ভাবুক এক মানুষ। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী কেপলার খুব তাড়াতাড়িই স্কুলের পাঠ সমাপ্ত করে ভর্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। বয়স তখন সবে ২০, সেই বয়সেই যোগদান করলেন গণিতের অধ্যাপক হিসেবে। এই একই সময় কেপলার টাইকোব্রাহের সংস্পর্শে আসেন এবং তার সহকারী হিসেবে বেশ কয়েকদিন কাজ করেন। কেপলারের আকাশ নিয়ে আগ্রহের পাশাপাশি গণিত নিয়েও আগ্রহের শেষ ছিলো না। প্রতিনিয়ত গবেষণায় মগ্ন থাকতেন কেপলার। গবেষণার তীর ছুটে যেতো সেই গণিত বিষয়টির দিকেই।

কিন্তু এর মাঝে কোপার্নিকাসের লেখা আকাশ সম্পর্কিত বই তার হাতে আসলে, তা পাঠ করে তার চিন্তা অন্যদিকে মোড় নেয়। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েই ভাবা শুরু করলেন। এর মাঝে আবার কেপলার কোপারনিকাসের অনেক মতকেই গ্রহণ করতে পারছিলেন না। কিভাবে সম্ভব? কেন সম্ভব? কেন এইভাবে না? কেন ওভাবে না? এইসব ব্যাপার প্রায়শই ঘুরপাক খেতো তার মনে। তিনি ভাবতে লাগলেন, সূর্য ও গ্রহ নক্ষত্রাদির পৃথিবীকে পরিভ্রমণ করা সহজ অথবা পৃথিবী তো নিজ অক্ষের উপরও আবর্তন করতে পারে।

কিন্তু শেষমেশ আর নিজের যুক্তিতে ঠেকেননি, কোপার্নিকাসের মতকেই কেপলার মেনে নেন। তার পরবর্তী সময়ে এই সম্পর্কিত একটি বই ও লিখে ফেলেন। বইয়ের নাম ‘ব্রহ্মান্ডের রহস্য’। আরও জানা যায়, বইটির যুক্তিগত বিচার বিশ্লেষণের জন্য বইটি গ্যালিলিওর কাছেও পাঠানো হয়। এই বইটির উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, বইটিতে এমন কিছু তথ্য ছিলো যা কিনা পরবর্তী গবেষকদের গবেষণার কাজেও দারুণ কাজে আসে। বলে রাখা ভালো, উল্লেখযোগ্য এই বইটির পাণ্ডুলিপি অত্যন্ত যত্নের সাথেই সংরক্ষণ করেছে জার্মানি।

ছবিসূত্র:geddesphysics.weebly.com

আকাশ নিয়ে, গ্রহ -নক্ষত্র নিয়ে কেপলার এমন কিছু সত্য তুলে ধরেছেন, যা পরবর্তীতে আর কেউই বের করতে সক্ষম হননি। কেপলারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পুস্তকটির নাম ‘নিউ অ্যাসট্রোনমি’। এটি প্রকাশের পর বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেন, সূর্যের চারদিকে গ্রহরা একটি উপবৃত্তাকার পথে পরিভ্রমণ করছে। তাই এরা ঘুরতে ঘুরতে কখনও সূর্যের কাছাকাছি চলে আসে আবার কখনও দূরে সরে যায়।

কেপলারই ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যিনি গ্রহদের গতিপথ নিয়ে সঠিক তথ্য দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি খুব যুক্তিযুক্তভাবে প্রমাণ করেছিলেন গ্রহের কক্ষপথ পুরোপুরি বৃত্তাকার নয়। কথিত আছে, কেপলার একটি অত্যন্ত শক্তিশালী দূরবীন তৈরি করেছিলেন। সেই দূরবীন দিয়েই তিনি গ্রহ, নক্ষত্র, এবং চন্দ্রের গতিবিধি লক্ষ্য করতেন। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, সেই দূরবীন দেখতে কেমন ছিল তা আজও জানা আর সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। কেননা বহু আগেই পৃথিবী থেকে যন্ত্রটি হারিয়ে যায়।

কেপলার এতটাই কর্মঠ ছিলেন যে, সারাদিন কাজের ফাঁকে তার শরীর কোনদিকে যাচ্ছে তা ভাববার সময়টুকুও তিনি রাখতেন না। তার উপর ছিলেন চিররুগ্ন অর্থাৎ ১২ মাসই তার রোগ লেগে থাকতো। কাজের চাপে খুব তাড়াতাড়ি তার শরীর ভেঙ্গে পড়ে। ৫৮ বছর বয়সেই এই বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। এই মানুষটিকে যদি আর কিছুদিন পাওয়া যেতো তবে নিঃসন্দেহে জ্যোতির্বিজ্ঞান আরও সমৃদ্ধ হতো।

ছবিসূত্র:www.jpl.nasa.go

কেপলারের জীবনী, আবিষ্কার, চিন্তাধারা দেখে একবার ভাবনা আসতেই পারে? কি করে এত কিছু হলো কেপলারের? যার উপোষ পেটে দিন চলতো, শিক্ষাদীক্ষাও কিনা শেষ সময়ে, এই কেপলারকেই আজ গোটা পৃথিবী মনে রেখেছে। আসলে কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। মৃত্যু অতি স্বাভাবিক ব্যাপার যাকে ধরে রাখবার সাধ্য আমাদের কারোরই নেই, কিন্তু কাজ নিয়ে ভাববার সাধ্য সবারই আছে।

আবিষ্কারে মন দিন, নিজের চিন্তাধারার পথকে আর একটু মাত্রা দিন। হয়তো আপনিই তেমন একজন যার আবিষ্কার পৃথিবী আগে কখনোই দেখেনি! মানুষ শব্দের সমার্থক শব্দ হিসেবে সম্ভাবনা শব্দটিকেই আমি প্রাধান্য দিবো বেশি। কারণ মানুষের অসাধ্য কিছু নেই, থাকতে পারে না!

তথ্যসূত্র: The Most Influential Persons in History by Michael H. Hart