নাইট ভিশন: ইনফ্রারেড টেকনোলজির ইতিবৃত্ত

Source: slideplayer

ইনফ্রারেড টেকনোলজির উদ্ভব ঘটেছিলো ঊনবিংশ শতাব্দীতে। যেটা কিনা বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন গবেষণা ফটোমেট্রি, কালারোমেট্রি এবং রেডিওমেট্রিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্টের মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটেছে। এছাড়া বিভিন্ন সামরিক ক্ষেত্রেও হয়েছে ব্যবহার। মূলত দিনে এবং রাতে উভয় সময়েই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব বিধায় সামরিক খাতে এর ব্যবহার শুরু হতে দেরি হয়নি। বর্তমান সময়ে সামরিক প্রযুক্তিতে ছাড়াও নিত্যদিনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যেমন টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনের রিমোটে এর ব্যবহার তো রয়েছেই।

ইনফ্রারেড টেকনোলজি কী?

ইনফ্রারেড রশ্মি মূলত আলোর ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক বর্ণালি একটি অংশ। ক্ষুদ্রাকৃতির ওয়েভের এই তরঙ্গ দিয়ে সাধারণ সল্প দূরত্বে তথ্য আদানপ্রদান করার কাজে ব্যবহার করা হয়। অনেক ইঞ্জিনিয়ার মনে করেন এই টেকনোলজি অপটিক্যাল টেকনোলজির একটি অংশ।

Source: slideplayer

কারন এই দুই ধরনের প্রযুক্তিতেই প্রায় একই ধরনের হার্ডওয়্যার ব্যবহার করার পাশাপাশি এনার্জির ব্যবহারও একই রকম। তবে বাস্তবিকপক্ষে তেমনটা নয়। কারন অপটিক্যাল বলতে দৃশ্যমান ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন বুঝায়। অন্যদিকে ইনফ্রারেড দিয়ে অদৃশ্যমান বুঝানো হয়। ইনফ্রারেড টেকনোলজি কিভাবে কাজ করে তার আগে চলুন জেনে নেওয়া যাক এর ইতিহাস।

ইতিহাস

ঊনবিংশ শতকের শুরুতে উইলিয়াম হার্শেল নামের একজন জ্যোর্তিবিজ্ঞানী ইনফ্রারেড তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রথমবারের মত লক্ষ্য করেন। প্রিজমের মাধ্যমে সূর্যের আলো প্রতিসরণ ঘটানোর সময় তিনি ইনফ্রারেড রশ্মির অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন।

প্রিজমে সূর্যের আলোর সাত রঙ বর্ণালিমে বিভক্ত হওয়ার পর সর্বশেষ লাল রঙের পর ইনফ্রারেড রশ্মির অস্তিত্ব তিনি খেয়াল করেন। আর থার্মোমিটার দিয়ে যখন তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে যান তখন থার্মোমিটারের তাপমাত্রা পরিবর্তন হতে দেখেন। তিনি সেই রশ্মির নামকরণ করেন ক্যালোরিফ রশ্মি হিসাবে। ইনফ্রারেড নামে এক রশ্মিকে ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ ভাগের আগে ডাকা হয়নি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আবিষ্কার হলেও ইনফ্রারেড রশ্মির ব্যবহার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তেমনভাবে হয়নি। প্রথম তৈরি করা ইনফ্রারেড প্রযুক্তি বিশিষ্ট্য ডিভাইস ছিলো দুই ধরনের। প্রথম ধরনের হচ্ছে, ইমেজ কনভার্টার টিউবের সাহায্যে ছবি প্রর্দশন করার ব্যবস্থা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে আইআরএসটি সিস্টেম। যেটা কি ইনফ্রারেড রশ্মি অনুসন্ধান আর চিহ্নিত করতে পারতে। এই দ্বিতীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে তৈরি করা হয় গাইডেড মিসাইল। যে মিসাইল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন অপারেশনে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে ইমেজ কনভার্টার টিউবের ব্যবহারও কোন অংশে ছিলোনা কম। আমেরিকা, জার্মানি আর রাশিয়া এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছিলো।

কনভার্টার টিউবে ব্যবহার করা ফটোইভেসিভ ডিরেক্টর সাহায্যে বেশ দূরের বস্তু তারা রাতেও দেখতে পারতো। তবে সেটা যথেষ্ট স্পষ্ট না হওয়াতে ব্যবহার করা হয় ইনফ্রারেড লাইট। সার্চ লাইটে দৃশ্যমান আলো ফিল্টারের সাহায্যে ঢেকে দিয়ে তারা এই ইনফ্রারেড লাইট বিভিন্ন মিশনে ব্যবহার করতো। যদিও এর মূল ব্যবহার ছিলো করতো বিভিন্ন কোভার্ট মিশনের স্নাইপাররা।

Source: slideplayer

ইমেজ কনভার্টার টিউব যেটাকে ইমেজ ইনটেন্সিফায়ার নামেও ডাকা হতো, তার উন্নয়ন ঘটে জার্মানদের হাত ধরে। ১৯৩৩ সালে জার্মান গবেষকরা তৈরি করেন বর্তমান সময়ের আইআর সিস্টেম। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এগডার কুটজসার আবিষ্কার করেন লিড সালফাইট ফটো কন্ডাকটিভ সনাক্তকারী হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব। এছাড়া লিড সালফাইট ব্যবহার করলে দীর্ঘকার আইআর রশ্মি ব্যবহারে করা যায়। যার ফলে বিভিন্ন গরম বস্তু, যেমন গাড়ির ইঞ্জিন জাহাজের ধোঁয়া নির্গত হওয়ার পাইপ দূর থেকে চিহ্নিত করা সম্ভব হতো।

পরবর্তীতে যখন এই ফটো কন্ডাকটিভ ডিটেক্টর যুক্ত করা হলো অপটিক্যাল, স্ক্যানার আর ক্যাথোড রে টিউবের সাথে তখন দেখা গেলো এই নতুন পদ্ধতিটি স্পষ্টভাবে ছবি প্রদর্শন করতে সহায়তা করছে।

Source: slideplayer

এই ডিভাইসের নামকরণ হয় আইআরএসটি হিসাবে। পরবর্তীতে জার্মানরা তাদের বিমানে আইআরএসটি ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে রাতের অন্ধকারে ইংলিশ চ্যানেলে জাহাজ চলাচল করা জাহাজ আর এলাইড বোম্বার বিমান সনাক্ত করা সহজ হয়ে ওঠে। তবে এর ব্যবহার পুরোদস্তুর শুরু হওয়ার আগেই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। তাই আইআরএসটি বৃহৎ আকারে উৎপাদনের মুখ দেখেনি।

ইনফ্রারেড টেকনোলজি কিভাবে কাজ করে?

ইনফ্রারেড রশ্মি আলোর একটি অংশ যেটা পূর্বেই বলা হয়েছে। এই টেকনোলজি সল্প দূরত্বের তারবিহীন যোগাযোগ আর ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে এই প্রযুক্তি টেলিভিশন বা এয়ারকন্ডিশন ছাড়াও রোবটিকস, তারবিহীন মাইক্রোফোন হেডসেট, মডেম অথবা প্রিন্টারে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ইনফ্রারেড ক্যামেরা তো রয়েছেই।

Source: slideplayer

ইনফ্রারেড ক্যামেরা কার্যপদ্ধতি সাধারণ ক্যামেরার মতো হলেও রয়েছে বেশ কিছু ভিন্নতা। প্রথমত এক বা একাধিক হিটিং ল্যাম্প এখানে ব্যবহার করা হয়। যেগুলো মূলত ইনফ্রারেড রশ্মি প্রদান করে। সেই রশ্মি যখন কোন বস্তুর উপর পরে তখন সাধারণত রশ্মির মতোই সেটা প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে আই আর ডিটেক্টরে সেন্সর এ্যরে তে। আইআর ডিটেক্টর সেই প্রতিফলিত রশ্মিকে এমপ্লিফাই করে ফিল্টারিং করার জন্য প্রেরণ করে কন্ট্রোলারের কাছে। এরপর কন্ট্রোলারে সিগনাল প্রসেসিং শেষে সর্বশেষ তথ্য ডিসপ্লেতে পাঠায়। যেখানে আমরা ইনফ্রারেড ছবি দেখতে পাই। বর্তমানে বিভিন্ন কর্পোরেট অফিস থেকে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে নিরাপত্তার জন্য ইনফ্রারেড ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

সীমাবদ্ধ

আমাদের নাইট ভিশন ক্ষমতা দান করলেও ইনফ্রারেড ক্যামেরার রয়েছে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা। প্রথমত এই রশ্নি লাইন অফ সাইটে কাজ করে। ফলে যেখানে এই রশ্মি পৌঁছাতে পারবে না সেখানকার চিত্র দেখাতে সক্ষম হবেনা। দ্বিতীয়ত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মতো দেয়াল ভেদ করার ক্ষমতা নেই এই রশ্মির।

ফলে বিভিন্ন সামরিক অপারেশনের কাজে দেয়াল ভেদ করে দেখার ক্ষমতা এই প্রযুক্তি দিতে পারেনি। তৃতীয়ত কোন বস্তু যদি গরম স্থান যেমন ইঞ্জিন বা বাষ্পের কাছাকাছি থাকে তাহলে তাকে ইনফ্রারেড ক্যামেরাতে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। চতুর্থ সমস্যা ইনফ্রারেড ক্যামেরার ছবি আসে সাদাকালো অথবা এক রঙে।

তবে অন্ধকারে সাদাকালো ছবি হলেও চারদিক স্পষ্ট দেখার ক্ষমতা এই রশ্মি আমাদের দিয়েছে যেটা কোন অংশেই কম নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *