এক ক্রিস্টিয়ানো ফ্যানবয়ের কাছে জাদুকর লিও মেসির পরাজয়

ইয়োহান ক্রুইফ, রিভালদো, রোনালদিনহোদের অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করে কাতালান জায়ান্ট ক্লাব বার্সেলোনাকে শ্রেষ্ঠ ক্লাবের কাতারে নিয়ে যাওয়া দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা লিওনেল মেসি সেবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন ফুটবলের তীর্থস্থান ব্রাজিল থেকে পেলে-ম্যারাডোনাদের চুমু খাওয়া সোনালি ট্রফিটা না ছুঁয়েই। এরপর চলে গেছে ৪টি বছর, নিজেকে তৈরি করেছেন আরেক লিও মেসি হিসেবে শুধুমাত্র আলবেসেলেস্তাদের একটি সোনালি ট্রফি উপহার দিতে। ২০১৭-১৮ সিজনের ইউরোপীয় গোল্ডেন বুট জেতা এ আর্জেন্টাইন জাদুকর রাশিয়ায় এসেছিলেন হাজারো স্বপ্ন নিয়ে।

কিন্তুু সবসময় সবদিনগুলো ভালো যাবে তা কিন্তু লেখা নেই ফুটবলারদের জীবনে। বাজে কোচিং স্ট্র্যাটেজি এবং ছন্দহীন টিম কম্বিনেশনে বহু কষ্টে রাশিয়ায় চলমান বিশ্বকাপের রাউন্ড অব সিক্সটিনে কোয়ালিফাই করে লিও মেসির আর্জেন্টিনা। গ্রুপপর্বের মতো এবার প্রতিপক্ষটা র‍্যাংকিং এ ১০ এর বাহিরের কেউ নয়, প্রতিপক্ষ ২০১৬ ইউরোর ফাইনালে পরাজিত ফ্রান্স যাদের ফুটবল ঈশ্বর কিংবন্তি জিনেদিন জিদান।

source: Independent.co.uk

দ্য গার্ডিয়ান, ইএসপিএন, স্কাই ইটালিয়ানো কিংবা নিউইয়র্ক টাইম সবাই ম্যাচটাকে আখ্যায়িত করেছিলো ‘ওয়ান’ স্টার vs ‘মিলিয়ন স্টার’ হিসেবে। কারণ ফ্রান্স ২০১৬ সালে ইউরোতে বাদ হওয়া সেই ফ্রান্স নয়, বর্তমান ফ্রান্স ফুটবল বিশ্বকাপ ২০১৮ এর সবচেয়ে শক্তিশালী দল বলা চলে। এদের ডিফেন্স ক্লাব ফুটবলের সর্বকালের সেরা দল বার্সেলোনার স্যামুয়েল ওমিতিটি এবং রিয়াল মাদ্রিদের রাফায়েল রাভানেকে নিয়ে, মিডফিল্ডে ২০১৪ বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান তারকার পুরষ্কার পাওয়া পল পগবা কিংবা প্রিমিয়ার লিগের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এনগোলো কন্তে এবং যুভেন্তাসের মাতইদির মতো সুপারস্টারদের নিয়ে গড়া।

অ্যাটাকিং লাইনে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার এন্তনিও গ্রিজম্যানের সাথে অলিভিয়ে জিরুড তো রয়েছেই, আর তাদের সঙ্গ দিচ্ছেন বার্সেলোনার তারকা ওসমান ডেম্বেলে এবং প্যারিস সেইন্ট জার্মেইনের সুপারস্টার ১৯ বছর বয়সী কিলিয়ান এম্বাপ্পে। বেঞ্চে রয়েছেন ফ্রেঞ্চ লিগের অন্যতম সেরা তারকা থমাস লেমার, নেবিল ফেকির, আরেওলা কিংবা বায়ার্নের টলেস্সদের মতো তারকারা। অন্যদিকে আর্জেন্টিনায় এক লিও মেসি এবং ডিফেন্সে ওটামেন্ডি ছাড়া বাকিসবাই ফর্মহীন বলা চলে। ওটামেন্ডিও গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলোতে নিজেকে হারিয়ে বসেছিলেন বটে। সেজন্যেই হয়তো ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচকে ইউরোপীয় ফুটবল পত্রিকাগুলো আখ্যায়িত করেছিলো ‘ওয়ান স্টার বনাম মিলিয়ন স্টার’ হিসেবে।

কাজান এরেনায় সেদিন দুপুরর ম্যাচের আগে অনেকেই হয়তো লিও মেসির জাদু কিংবা ফ্রান্সের টিম ওয়ার্কে ইতিহ্যবাহী ইউরোপীয় দৃষ্টিনন্দন ফুটবল দেখার অপেক্ষায় ছিল। বলতে গেলে রাউন্ড অব সিক্সটিনের অন্যতম হাই ভোল্টেজ ম্যাচ ছিলো সেটি। পত্রিকাগুলো সেদিন হেডলাইন করেছিলো ‘লিও মেসি নাউ অর নেভার” কিংবা ‘Leo vs European Powerhouse‘ বলে। কেউ কেউ আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে রাখছেন কেউবা ফ্রান্সকে, কিন্তু মূল লড়াই দেখা গেলো কাজানের সবুজ কার্পেটে লাতিনদের লজ্জাজনক পরাজয়ে। কে কী উপভোগ করেছেন জানি না তবে ম্যাচের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডারদের আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে নিজেদের ইউরোপীয় ফুটবলের পাওয়ার হাউজ হিসেবে প্রমাণ করতে দেখে গিয়েছিলো একজন কিশোরকে।

ম্যাচ শুরুর দিকে এন্তনিও গ্রিজম্যানের ফ্রি কিক বারে লাগলেও এর মিনিট ছয়েক পর আবারো পেনাল্টি আদায় করে নেয় ফ্রান্স। সাম্পাওলি সেদিন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফুলব্যাক মার্কোস রহোকে স্টার্ট করিয়েছিলেন শুধু একজনকে থামাতে। যারা সেদিন ফ্রান্স-আর্জেন্টিনা ম্যাচ দেখেছেন তারা এতক্ষণে বুঝে গেছেন কার কথা বলছি। ঠিক ধরেছেন ফ্রান্সের নাম্বার টেন, পিএসজি তারকা কিলিয়েন এম্বাপ্পের কথাই বলছি, যাকে ধরা হয় আগামীর ব্যালনডি’অর এর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে রিয়াল-বার্সার মতো দল থেকে অফার পাওয়া কিশোরকে নিয়েই যে ছিলো সাম্পাওলির সবচেয়ে বেশি মাথাব্যাথা তা রহ্যোকে স্টার্টিং এ দেখে বুঝতে বাকি রইলো না। কিন্তুু গ্রুপপর্বে গোল করে নায়ক বনে যাওয়া মার্কোস রহো ১২ মিনিটেই হয়ে গেলেন ভিলেন। এম্বাপ্পের দূর্দান্ত গতি এবং অসাধারণ স্কিলের সামনে সেদিন এত অল্প সময়ে হেরে যাবে মার্কোস রহো তা হয়তো স্বয়ং সাম্পাওলি নিজেও ভাবেননি। এম্বাপ্পেকে থামাতে গিয়ে বাজে ট্যাকেল করেন রহো, যার ফলশ্রুতিতে ফ্রান্স পায় পেনাল্টি।

সময় তখন ঠিক ১৩ মিনিট আর এন্তনিও গ্রিজম্যানের গোল দুই মিলে ডি-বক্সের পাশে দাড়িয়ে থাকা জাদুকর লিও মেসির চোখে পানি, হয়তো খোদ ফুটবল ঈশ্বর পর্যন্ত এটা মেনে নিতে পারেননি। এরপর খেলা চললো আধঘণ্টার মতো দু’দলই গোল মিসের মহড়া দিলো অনেক্ষণ, বস্তুত ফ্রান্স আক্রমণের হিসেবে এগিয়েই ছিলো প্রথমার্ধে। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার মিনিট চারেক আগে ভেনেগা থেকে বল পেয়ে ডি বক্সের বাহির থেকে নান্দনিক এক শটে পরাস্ত করেন ফ্রান্সের গোলরক্ষক হুগো লরিসকে। ঐ গোলের সাথে কাজান স্টেডিয়াম যেন প্রাণ ফিরে পায়, হাজার দর্শকরা মেতে উঠলো জয়োচ্ছ্বাসে।

লিও মেসি ডি মারিয়াকে জড়িয়ে ধরে দু’ফোঁটা অশ্রুবিসর্জন দিয়েছিলেন সেটা একাধিকবার জুম করে দেখিয়েছিলো প্রথমার্ধের শেষে বিরতিতে। বিরতির সময় ফ্রান্স ১:১ আর্জেন্টিনা স্কোরবোর্ডটা যখন গোটা বিশ্বের আর্জেন্টাইনদের নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছিলো ঠিক তখনি ফ্রান্সের ড্রেসিংরুমে কালো স্যুট পরা দিদিয়ের দেশমও এঁকে ফেলছিলেন মেসিদের পরাস্ত করার নতুন নীলনকশা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই মেসির শট যখন আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার মার্কাডোর পায়ে লেগে হুগো লরিসকে পরাস্ত করে তখন গোটা বিশ্ব হয়তো ফ্রান্সের পরাজয় এবং লিও মেসির আর্জেন্টিনার জয় দেখে ফেলেছিলো ক্ষণিকেই। সেই গোলের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং কাজানের আর্জেন্টাইন সমর্থকদের উল্লাস তারই বহিঃপ্রকাশ ছিলো।

পগবা-গ্রিজম্যানদের মুখে যখন চিন্তার ছাপ তখন ১৯ বছর বয়সী সেই কিশোর এম্বাপ্পেকে বার বার আর্জেন্টাইনদের দেয়াল আক্রমণ করতে দেখে গিয়েছিলো। তাকে রুখতে গিয়েই হলুদ কার্ড দেখেন মাশ্চেরানো। খেলা যখন ৫৬ মিনিটে গড়ালো তখন সুন্দর একটি আক্রমণ সাজিয়েছিলো ফ্রান্স। অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের ফুলব্যাক তরুণ ফুটবলার লুকাস হার্নান্দেজের অ্যাসিস্টে দুর্দান্ত ভলিতে গোল করে ফ্রান্সকে সমতায় ফেরান আরেক ফুলব্যাক বেঞ্জামিন পাভার্ড, তাকে রুখতে ব্যর্থ হয় ওটামেন্ডি-মার্কাডো-মাশ্চেরানোরা।

সেই গোল হজম করার পরই ছন্দ পতন ঘটে লাতিন পরাশক্তি আর্জেন্টিনার। ডিফেন্স থেকে শুরু করে মিডফিল্ড সবকিছুই এলোমেলো, লিও মেসি যেন হারিয়ে গেছেন তখন। ৬৪ মিনিটের মাথায় আর্জেন্টাইন ডি বক্সে ৪ জনকে পরাস্ত করে ফ্রান্সকে লিড এনে দেন সেই কিশোর কিলিয়েন এম্বাপ্পেকে। চারজনকে ড্রিবলিং এ পরাস্ত করে বাঁ পায়ে অসাধারণ গোল করেন এম্বাপ্পে যা ছিলো দেখার মতো।

এম্বাপ্পের গোল; source: Independent.co.uk

এরপর আর আর্জেন্টাইনদের ম্যাচে খুঁজে পাওয়া যায়নি পল পগবার মার্কিং এ লিও মেসি একেবারেই ফ্লপ ছিলেন পুরো দ্বিতীয়ার্ধটা। কিলিয়েন এম্বাপ্পের স্কিল, ড্রিবলিং, গতিময় ফুটবল যেমন ইউরোপীয়দের ফুটবলীয় ক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছিলো তেমনি কাজানের মানুষগুলোকে ৩০ মিনিটের জন্য লিও মেসিকে ভুলিয়ে দিয়েছিলো। ততক্ষণে মানুষজন কিলিয়েন এম্বাপ্পেতে মুগ্ধ, কাজানের জাদুকর তখন লিও মেসি নন জাদুকর তখন এম্বাপ্পে। ফ্রান্সের তৃতীয় গোল যখন হয় তখন কাজান এরেনায় ঘড়ির কাঁটা ৬৪ মিনিটে।

এর ঠিক মিনিট চারেক পরই ভারানে টু গ্রিজম্যান, গ্রিজম্যান টু অলিভিয়ে জিরুড এবং জিরুড টু এম্বাপ্পে দুর্দান্ত কাউন্টার অ্যাটাকে ফ্রান্সের হয়ে ৪র্থ গোলটি করেন কিলিয়েন এম্বাপ্পে। তার গোলটি মোকাবেলা করার ক্ষমতা তখনো হয়নি আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক আরমানির! দূর থেকে ওটামেন্ডি-মাশ্চেরানো শুধু চেয়ে দেখছিলেন করার যে কিছু ছিলো না সেটা ভেবেই, কাজান এরেনায় তখন স্কোরবোর্ড ফ্রান্স ৪:২ আর্জেন্টিনা! গোটা ইউরোপ জুড়ে খুশির বন্যা আর অশ্রুসিক্ত হয়ে আর্জেন্টাইন জার্সি গায়ে লাতিন আমেরিকা কোটি জনতা, ভিআইপি বক্সে কিংবদন্তি ম্যারাডোনার চোখ মুখে শোকের ছায়া।

এরপর ফ্রান্স কিছু দুর্দান্ত সুযোগ সৃষ্টি করলেও গোল করতে পারেনি নিজেদের ব্যর্থতায়। ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত ৩ মিনিট দেয়া হয়, জ্বলে উঠলেন লিও মেসি, ডি বক্সের বাহির থেকে তার করা দুর্দান্ত ক্রস থেকে হেডে গোল করেন শেষদিকে মাঠে নামা সার্জিও আগুয়েরো। কিন্তুু ড্র করতে হলেও যে লাগবে আরো কিছু সেটা ঠিকই মনে রেখেছিলেন জাদুকর লিও মেসি। মনে রেখে কীইবা হবে?

অতিরিক্ত সময়ের পর খেলা শেষ হওয়ার বাঁশি যে ততক্ষণে বেজে গেছে। দুর্দান্ত কিলিয়েন এম্বাপ্পের কাছে হেরে গেলো জাদুকর লিও মেসির আর্জেন্টিনা। সেদিন খেলা শেষে মাঠে লিও মেসির অশ্রুবিসর্জন আর গ্যালারিতে কিংবদন্তি ম্যারাডোনার চোখের জল কাজান এরেনাকে আরো ৪ বছর মনে করিয়ে দিবে কোটি কোটি আলবেসেলেস্তাদেরকে। সাথে মনে করাবে ফ্রান্সের হয়ে কাজানকে স্মরণীয় করা সেই রাতের নায়ক কিলিয়ান এম্বাপ্পেকে।

এম্বাপ্পে এবং মেসি; source: republicworld com

১৯৯৮ সালের ২০ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ফিফা প্রো ইলাভেনে জায়গা পাওয়া এ তরুণ ফুটবলার। তার পিতা উইলফ্রাইড ক্যামেরন এবং মা ফায়জা লাম্রেই আলজেরিয়ান বংশদূত। মাত্র ৫ বছর বয়সে ‘এস বন্ডেই’ এর হয়ে ফুটবলের একাডেমিক ক্যারিয়ার শুরু হয় তার। তখন সে একাডেমির কোচ ছিলেন তার পিতা উইলফ্রাইড।

এম্বাপ্পের বয়স যখন ১১ তখন তার জুনিয়র একাডেমিক ফুটবল গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়। সেকালে সে এতটাই বিখ্যাত বনে গিয়েছিলো যে তৎকালীন ম্যানচেস্টার, রিয়াল-বার্সা, চেলসি-আর্সেনালের স্কাউটরা প্যারিসে ছুটে গিয়েছিলো তাকে দলে নেয়ার জন্য। কিন্তুু এম্বাপ্পের পিতা চাননি তিনি কখনো ফ্রেঞ্চ লিগের বাহিরে খেলুক, যার ফলশ্রুতিতে এম্বাপ্পের নতুন ঠিকানা হয় দ্বীপরাষ্ট্র মোনাকোতে। জেনে রাখা ভালো, মোনাকো একটি দেশ, তারা ছোট্ট বিধায় ফ্রেঞ্চ লীগে ফুটবল খেলে থাকে। ২০১৫-১৬ সিজনে মাত্র ১৬ বছর ৩৪৭ দিন বয়সে ফ্রেঞ্চ লীগে তার অভিষেক হয়, ঐ রেকর্ডটি গড়তে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলেন থিয়েরে হেনরীর ২১ বছর আগেকার রেকর্ডটি।

এম্বাপ্পে মোনাকোর হয়ে প্রথম গোল করেন ২০১৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, তখন তার বয়স সবেমাত্র ১৭ বছর ৬২ দিন। বলতে গেলে মোনাকোর হয়ে তখন তিনি প্রায় নিয়মিতই খেলছিলেন। তবে বিশ্ব ফুটবল আসল কিলিয়েন এম্বাপ্পেকে চিনতে পারে ২০১৬-১৭ সিজনে। তখনই এম্বাপ্পে জীবনের প্রথম প্রফেশনাল ফুটবলার হিসেবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এস মোনাকোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হন এবং চুক্তি অনুসারে এম্বাপ্পের এজেন্ট নিযুক্ত হন তার পিতা উইলফ্রাইড। ২০১৬-১৭ সিজনে ফ্রেঞ্চ লিগে দুর্দান্ত খেলছিলো মোনাকো, এর পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান কিলিয়েন এম্বাপ্পে এবং রাদামেল ফ্যালকায়ের।

এম্বাপ্পে মোনাকোর হয়ে প্রথম হ্যাট্ট্রিক করেন ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে তার জন্মদিনের ৩ দিন পরে, ঐ ম্যাচে মোনাকো ৭:০ গোলে পরাজিত করে রেনিসকে কোপা ডি ফ্রেঞ্চের রাউন্ড অব সিক্সটিনে। ফ্রেঞ্চ লিগে এম্বাপ্পে প্রথম হ্যাট্ট্রিক করেন ২০১৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাত্র ১৮ বছর ২ মাস বয়সে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ (প্রথম করিম বেনজেমা) ফ্রেঞ্চ ফুটবলার হিসেবে ম্যানসিটির বিপক্ষে ইউরোপা লিগের রাউন্ড অব সিক্সটিনে গোল করেন এম্বাপ্পে, যদিও সে ম্যাচে ম্যানসিটির কাছে হেরে বিদায় নেয় মোনাকো।

মোনাকোর এম্বাপ্পে; source: fracne24.com

এদিকে ফ্রেঞ্চ লিগের একের পর এক রেকর্ড নিজের করে নিচ্ছিলেন তখন এম্বাপ্পে। মাত্র ৮২২ মিনিট খেলে ৯ গোল এবং ৭ অ্যাসিস্ট করে ফ্রেঞ্চ লিগে গড়লেন অনন্য এক রেকর্ড যা এর আগে বিরল। প্রথম ৪ ম্যাচে স্টার্টিং ইলাভেনে থেকে ৭ গোল করার অনন্য রেকর্ডটিও কিশোর এম্বাপ্পেরই গড়া। সেবার এত রেকর্ড গড়ে ২৬ গোল করে সিজন শেষ করেন ক্লাব মোনাকোকে ফ্রেঞ্চ লিগ জিতিয়ে। ইউরোপীয় জায়ান্ট দলগুলো ততদিনে মুখেয়ে তাকে দলে বাগানোর তাগিদে।

কতশত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অপেক্ষায় ছিলেন তার পিতার সিদ্ধান্তের। এর মাঝেই ইংরেজ মিডিয়ায় ফাঁস হলো তার বেডরুমের ছবি যার দেয়াল মোড়ানো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পোস্টারে। টনক নড়ে রিয়াল মাদ্রিদ কৃতপক্ষের, টনক নড়ে রিয়াল মাদ্রিদ কোচ জিনেদিন জিদানের। এর মাঝে স্কাই স্পোর্টস প্রকাশ করে এম্বাপ্পের আরেক দুর্লভ ছবি যেখানে সে রোনালদোর সাথে পোজ দিচ্ছেন হাসি মুখে। রিয়াল মাদ্রিদ ভ্রমণে এসে ১৬ বছর বয়সে এম্বাপ্পে রোনালদোর সাথে দেখা করে গিয়েছেন, তখন এক ইন্টারভিউতে উল্লেখ করেছেন রোনালদো সম্পর্কে তার নানাবিধ কথা। রোনালদো সম্পর্কে তার কথাগুলোর একাংশ –

“আমার শৈশবকাল থেকে আমি রোনালদোকে পছন্দ করতাম, তিনি আমার আইডল। তার সাথে দেখা করতে আমি মাদ্রিদে এসেছি। আমি তার সাথে খেলার স্বপ্ন দেখি, যদি কখনো তা সম্ভব হয় তাহলে আমি ঈশ্বরের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।”

ক্রিস্টিয়ানো সাথে এম্বাপ্পে; source: Twitter/Marca

তখন যদি স্পেনিশ পত্রিকা মার্কা জানতো যে, সেই এম্বাপ্পে আজ যাদুকর বনে যাবে তাহলে সেদিনের নিউজটা মূল পাতায় প্রকাশ করতো। এত গুজব, ছবি ফাঁসের পর জিনেদিন জিদানের সম্মতিতে মোনাকোকে প্রস্তাব দিয়ে বসে রিয়াল মাদ্রিদ ২০১৭ সালের জুন মাসে, টাকার অঙ্কে ১৫০ মিলিয়ন ইউরো। সমস্ত সিদ্ধান্ত তার হাতে, তিনি চাইলে মোনাকো তাকে যেতে দিবে মাদ্রিদে। কিন্তু তার পিতা উইলফ্রাইড বুঝতে পারেন ফ্রান্সের হয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপ খেলতে হলে এম্বাপ্পেকে নিয়মিত হতে হবে লিগে। রিয়াল মাদ্রিদে তখনও গ্যারেথ বেল, লুকাস ভাসকেসের মতো তারকারা আলো ছড়াচ্ছে, এর মাঝে এম্বাপ্পেকে সব ম্যাচে স্টার্টিংএ রাখবে না এটা এক প্রকার ধরে নেয়াই যায়।

সমস্ত বিষয় নিরীক্ষা করে এম্বাপ্পের পিতা তাকে মোনাকোতে থাকার কথাই বলেন। ভদ্র ছেলের মতো এম্বাপ্পেও তার পিতার কথা শুনে মোনাকোতে থেকে গেলেন, স্বপ্ন মোনাকোতে নিয়মিত খেলে ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশমের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন এবং বিশ্বকাপ খেলবেন। এর মাঝে এম্বাপ্পেকে কেনার প্রস্তাব দিয়ে বসলো তার জন্মভূমি প্যারিসের ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইন, তাকে নিয়মিত খেলানোর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েই প্রস্তাবখানা মোনাকোতে পাঠিয়েছিলেন পি.এস.জি প্রেসিডেন্ট।

মোনাকো কৃতপক্ষ, এম্বাপ্পের বাবা সবাই রাজি হলেও বাধ সাধে ইউরোপীয় ফুটবলের সর্বোচ্ছ নিয়ন্ত্রণকারী কৃতপক্ষ UEFA। কারণ তখন ফুটবল ইতিহাসের রেকর্ড সংখ্যক ট্রান্সফার ফি দিয়ে ব্রাজিলিয়ান সেনসেশন নেইমারকে দলে নিয়েছিলো ফ্রান্স। ট্রান্সফার ফি এর লিমিটেশন ভঙ্গ হওয়ার ভয়ে PSG এক বছরের জন্য ধারে এম্বাপ্পেকে দলে আনে ২০১৭-১৮ সিজনের শুরুতে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ২০১৮-১৯ সিজনে PSG মোনাকোকে ১৬৫ মিলিয়ন ইউরো পরিশোধ করে স্থায়ীভাবে নিজেদের একজন করে নিবে এম্বাপ্পেকে।

P.S.G তে এম্বাপ্পে পিতার সাথে; source: PSG official

প্যারিসের হয়ে শুরু হওয়া ফুটবল জীবনে এম্বাপ্পে পূর্ণ করেন নিজের ক্যারিয়ারের ১০তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ গোল, আর গড়েন আরেক অনন্য রেকর্ড। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে ১০ গোল করার রেকর্ড এখন কিলিয়ান এম্বাপ্পের। প্যারিসের হয়ে চলতি সিজনে অসাধারণ খেলে জিতেছেন তিনটি ট্রফি। ছোট্ট এ ক্লাব ক্যারিয়ারে ২টি লিগ ট্রফি সহ আরো দুটি ফ্রেঞ্চ ফুটবল ট্রফি জিতে নির্বাচিত হয়েছেন গোল্ডেনবয় ২০১৭ হিসেবে। এত এত রেকর্ড গড়া কিলিয়ান এম্বাপ্পে ভাগ্যের জোরে জিতেননি এসব, জিতেছেন নিজের টেলেন্ড এবং হার্ডওয়ার্ক কে কাজে লাগিয়ে। অন্যদিকে তার আইডল তো আবার রেকর্ডের রাজপুত্র ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নিজে।

গোল্ডেনবল হাতে এম্বাপ্পে; source:Goal.com

লিগে এত এত রেকর্ড, গোল, পার্ফম্যান্সের পুরষ্কার স্বরুপ এবার এম্বাপ্পে ডাক পান ফ্রান্সের বিশ্বকাপ দলে। ফ্রেঞ্চ কোচ দিদিয়ের দেশম তার হাতে তুলে দেন জিনেদিন জিদানের সেই দশ নাম্বার জার্সিটাই, আর দায়িত্ব দেন ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ জেতাবার। মাত্র ১৯ বছর ১৯২ দিন বয়সে ৪র্থ কনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপের নক আউটে গোল করে নিজেকে বসিয়েছেন রেকর্ডবুকে পেলে, জুলিয়েন গ্রিন এবং মিশেল ওউনদের কাতারে। সেইসাথে নক আউটে সবচেয়ে কম বয়সে দুই বা ততোধিক গোল করা রেকর্ডটি ফুটবলের সর্বকালের সেরা পেলের পর কিলিয়ান এম্বাপ্পের দখলে।

রেকর্ড গড়া আর ভাঙ্গার বিশ্বকাপে নিজের জাত চিনিয়ে চলেছেন এ তরুণ ফুটবলার, প্রমাণ করে যাচ্ছেন নিজেকে জিনেদিন জিদানের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দু’গোল করে রেকর্ড গড়ায় স্বয়ং পেলে তাকে অভিনন্দন জানান টুইটারে, ছোট্ট এ জীবনে এতশত রেকর্ডের মাঝে আর কী বা লাগে নিজেকে এবং নিজের পিতাকে গর্বিত করতে? ২০১৬ সালে তার পিতা বলেন “এম্বাপ্পে বেশিরভাগ সময় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গোল, স্কিল দেখেই সময় পার করতো অবসরে।” আর সেই রেকর্ডের রাজা ক্রিস্টিয়ানোর পথেই হাঁটছেন কিলিয়ান এম্বাপ্পে। যোগ্য আইডলের যোগ্য শিষ্য হিসেবে নিজের জাত চেনাচ্ছেন গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে।

শনিবার বিশ্বকাপের নক আউটে এই রেকর্ডের রাজপুত্র ফ্রান্সের কিলিয়ান এম্বাপ্পের দুর্দান্ত পার্ফম্যান্সেই বিদায় নিয়েছিলো ফুটবলের জাদুকর খ্যাত বার্সেলোনার কিংবদন্তি লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। সেই ম্যাচে এম্বাপ্পে দুটি গোল এবং একটি পেনাল্টি আদায় করে দিয়েছিলেন ফ্রান্সকে। বিশ্বকাপে সবচেয়ে গতিময় ফুটবল খেলার রেকর্ড ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ৩৮.৭ কিলোমিটার প্রতিঘন্টায় বেগ, কিন্তু নিজের আইডলের রেকর্ডেও ভাগ বসাতে দ্বিধাবোধ করেনি এম্বাপ্পে। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সমান গতিতে খেলে ক্রিস্টিয়ানোর রেকর্ডে ভাগ বসালো সে, সেই সাথে উসাইন বোল্ডের পর অ্যাথলেটদের মধ্যে দ্রুতগতির হিসেবে তৃতীয় স্থানে থাকার রেকর্ডটি নিজের করে নিলেন গর্বিত পিতা উইলফ্রাইড এর ছেলে কিলিয়ান এম্বাপ্পে।

এতকিছুর পর বলার বাকি থাকে না যে, তিনি প্যারিসের রাজপুত্র, জিনেদিন জিদানের ঐতিহাসিক ১০ নম্বর জার্সির রক্ষক এম্বাপ্পের কাছেই সেদিন হেরে গিয়েছিলো ফুটবলের জাদুকর লিও মেসির আর্জেন্টিনা। আপনি-আমি না মানলেও কাজান এরেনার ৪৬ হাজার দর্শক এবং ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনা যে সাক্ষী সেদিনের তা কি অস্বীকার করার মতো? হয়তো মেসি-রোনালদো যুগের পতনের কারণ হবে এ কিশোর এম্বাপ্পে ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে, দেখিয়ে দিবে বিশ্বকে জিদানের দশ নম্বর জার্সি পরে সে খেলেছিলো রাশিয়াতে।

ফুটবল এমনই, আমাদের যেমন উপহার দিয়েছিলো ‘১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের নাটকীয় ফাইনাল তেমনি উপকার দিয়েছে ফুটবল বিশ্বে মেসি-রোনালদোর রাজকীয় দ্বৈরথ। নতুন কেউ আসবে, নতুন কেউ রাজত্ব করবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম ফেনোমেনন, জিদান, দিনহোদের দেখে ফুটবলে মেতেছিলো। আমরা মেতেছি তর্কাতর্কির সাগরে, ভেসেছি মেসি-রোনালদোদের নিয়ে। সেই হিসেবে হয়তো আগামীর ফুটবল হবে নেইমার-এম্বাপ্পেদের নিয়ে এটিই নিয়ম, তবুও মেসি-রোনালদো থাকবেন ফুটবলের সর্বকালের সেরাদের কাতারে এটিও স্বাভাবিক।

ম্যাচ শেষে যাদুকরের সাথে এম্বাপ্পে; source: republicworld.com

বিশ্বকাপের রাউন্ড অব সিক্সটিন শেষ হয়েছে, কোয়াটার ফাইনাল শুরু হবে, সেখানে বিশ্ব মিস করবে মেসি-রোনালদো দু’জনকেই। তবে আশা করছি এম্বাপ্পে-নেইমার-হ্যাজার্ডরা নান্দনিক ফুটবল উপহার দিয়ে মাতিয়ে রাখবে বিশ্বের সকল ফুটবলঅন্ধ ভক্তদের আর মনোমুগ্ধকর করবে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থকে’।

SOURCE: http://khela.co/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *