দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জিতেছে যে ৬টি দেশ

0

Image result for FRANCE WORLD CUP 1998

যেকোনো খেলায়ই স্বাগতিক দেশ বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। কারণ যে দল ঘরের মাঠে খেলে তাদের সবকিছু পরিচিত। পরিবেশ, আবহাওয়া কিংবা খেলার মাঠ, সবই চেনা-জানা। সেই সাথে হাজার হাজার মানুষের সমর্থন তো থাকছেই। সে কারণে ঘরের মাঠে যে কোনো দল, যে কোনো খেলায় বাড়তি সুবিধা পায়, বাড়তি সমর্থন পায়। যেটা দিয়ে প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ভালো ফল করা খুবই সহজ। তবে স্বাগতিক দেশ সব সময় শুধু পরিচিত পরিবেশ এবং দেশের সমর্থকদের কারণে বাড়তি সুবিধা পায় সেটা অনেকেই বিশ্বাস করেন না। এক সময় একটা মিথ প্রচলিত ছিলো যে, স্বাগতিক দেশ বাড়তি এবং অন্যায় সুবিধা নিয়ে থাকে অন্য দেশগুলোর চেয়ে। তবে সেটা ভাবার যথেষ্ঠ কারণও ছিলো।

ফিফা বিশ্বকাপ; Source: fifa.com

গত শতাব্দির ‘৩০ এর দশকে যখন বিশ্বকাপ শুরু হয় তখনই ঘরের মাঠে দুইটি বিশ্বকাপ জিতে নেয় উরুগুয়ে এবং ইতালি। সেই থেকে অনেকে ধারণা করতেন যে, স্বাগতিক হওয়ার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। পরবর্তীতে ইতালি এবং উরুগুয়ে অন্য দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জিতে সেই মিথ ভেঙেছে। তবে স্বাগতিক দেশ হিসেবে যে একেবারে কোনো সুবিধা পায়না সেটাও নয়। বর্তমানে রাশিয়াতে ২১তম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর আগের ২০টি বিশ্বকাপের মধ্যে ৬টি বিশ্বকাপ জিতেছে স্বাগতিক দেশ।

এবারের বিশ্বকাপের আসর বসেছে রাশিয়ায়। ফিফার ৭০তম দল রাশিয়াকে নিয়ে খুব বেশি প্রত্যাশা ছিলো না ফুটবল ভক্তদের। কিন্তু ঘরের মাঠের সেই রাশিয়া বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেনকে হারিয়ে দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে। কোয়ার্টার ফাইনালে তারা লড়াই করে দূর্ভাগ্যক্রমে টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরেছে অথচ এই ক্রোয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে হেরেছিলো লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। রাশিয়ার এসব কিছু সম্ভব হয়েছে তাদের পরিচিত পরিবেশ এবং দেশের মানুষের সমর্থনের কারণে। তবে স্বাগতিক হয়ে সবচেয়ে বেশি কপাল পুড়েছে ব্রাজিলের।

রাশিয়া বিশ্বকাপে দারুণ করেছে স্বাগতিক রাশিয়া; Source: tns.world

ব্রাজিলের দুইবার বিশ্বকাপের আসর বসেছে, দুইবারই তারা হেরেছে। প্রথম ১৯৫০ সালে বিখ্যাত ‘মারাকানাজো’ এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলের হার। এতকিছুর হিসাব না মিলিয়ে চলুন ঘরের মাঠে ফিফা বিশ্বকাপ জিতেছে যে ৬টি দেশ।

উরুগুয়ে

বিশ্বকাপের ইতিহাস লিখতে হলে সবার শুরুতে উরুগুয়ের নামটি লিখতে হবে। ১৯৩০ সালে যখন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হলো তখন প্রথমেই শিরোপা জিতে নেয় উরুগুয়ে। তখন এই শিরোপার নাম ছিলো জুলে রিমে ট্রফি। রাশিয়া বিশ্বকাপেও ফেবারিট হিসেবে খেলতে এসেছিলো উরুগুয়ে এবং ফেবারিটদের মতোই পর্তুগালকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায় উরুগুয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের কাছে হেরে তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। উরুগুয়ে দুইবার বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে। যার মধ্যে একবার জিতেছে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে, অন্যবার জিতেছে ব্রাজিলকে হারিয়ে। উরুগুয়ে তাদের প্রথম শিরোপা জিতেছে ১৯৩০ সালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে। ১৯৩০ সালে প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপের আসর বসে উরুগুয়েতে।

১৯৩০ বিশ্বকাপে শিরোপা জিতে নেয় উরুগুয়ে; Source: fifa.com

ফাইনাল ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিও এর এস্তাদিও সেন্তেনারিও স্টেডিয়ামে। ফাইনালে প্রথমে আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে এগিয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেয়। উরুগুয়ের পক্ষে গোল করেন পাবলো দোরাদো, পেদ্রো সিয়া, সান্তোস ইরিয়ার্তে এবং হেক্টর ক্যাস্ট্রো। উরুগুয়ে এরপর ১৯৫০ সালে ব্রাজিলের মাটিতে বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে ‘মারাকানাজো’ সৃষ্টি করে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয়। কিন্তু এরপর আর উরুগুয়ে বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। এমনকি ফাইনালও খেলতে পারেনি।

ইতালি

বিশ্বকাপে এক সময় ইতালি ছিলো সবচেয়ে ভয়ংকর এক দল। ইতালি মোট চারবার ফিফা বিশ্বকাপ জিতেছে। যার প্রথমবার ছিলো ১৯৩৪ সালে এবং সর্বশেষ তারা বিশ্বকাপ জিতেছে ২০০৬ সালে। ইতালিও উরুগুয়ের মতো স্বাগতিক দেশ হিসেবে ১৯৩৪ সালে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে নেয়। রোমের এস্তাদিও নেজিওনালে পিএনএফ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ইতালি এবং চেকোস্লোভাকিয়ার ফাইনালটি প্রথমাবারের মতো অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। ম্যাচের ১৯তম মিনিটে চেকোস্লোভাকিয়াকে এগিয়ে দেন আন্তোনিন পুচ। কিন্তু পরে রাইমুন্ডো অর্সি ইতালির হয়ে গোলটি পরিশোধ করেন। নির্ধারিত ৯০ মিনিটে ম্যাচটি ১-১ গোলে সমতায় থাকার কারণে ম্যাচটি গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

১৯৩৪ বিশ্বকাপ জয়ের পর স্বাগতিক ইতালির উল্লাস; Source: fifa.com

অতিরিক্ত সময়ের পাঁচ মিনিটের মধ্যে অ্যাঞ্জেলো শিয়াভিও ইতালিকে এগিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত ঘরের মাঠে ইতালি ২-১ ব্যবধানে চেকোস্লোভাকিয়াকে হারিয়ে প্রথমবারে মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয়। ১৯৩৮ সালে ফ্রান্সে বিশ্বকাপও জিতে নেয় ইতালি। এছাড়া ১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপ এবং ২০০৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ জিতেছে ইতালি।

ইংল্যান্ড

১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় এবং ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ আয়োজন করে সেটিতে চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপ অনেকগুলো কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে। বিশ্বকাপের শিরোপা চুরি হয়ে যাওয়া, পিকলস নামের এক কুকুরের মাধ্যমে সেটি খুজে পাওয়া, ফাইনালে জিওফ হার্স্টের হ্যাটট্রিক এবং বিতর্কিত এক গোল। সবকিছু মিলিয়ে দারুণ এক বিশ্বকাপ ছিলো।

ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে স্বাগতিক দেশ হিসেবে বিশ্বকাপটি জিতে নেয় ইংল্যান্ড। লন্ডনের পুরাতন ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফাইনালে নির্ধারিত ৯০ মিনিটে ম্যাচটি ২-২ গোলে সমতায় থাকার পর ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে জিওফ হার্স্ট আরো দুই গোল করে ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপের শিরোপার এনে দেন।

১৯৬৬ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জয় করে ইংল্যান্ড; Source: fifa.com

জিওফ হার্স্ট একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাটট্রিক করার রেকর্ড গড়েন যা এখনো অক্ষত রয়েছে। তবে জিওফ হার্স্টে দ্বিতীয় গোল নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছে যার শেষ এখনো হয়নি। রেফারি গটফ্রিড ডিনস্ট ইংল্যান্ডের পক্ষে বিতর্কিত এক গোল দেন। গোললাইন অতিক্রম না করার পরও গোল দেওয়ার কারণে এখনো সেটি নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে।

পশ্চিম জার্মানি

১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের কাছে হারের ৮ বছর পর আবারো ফাইনালে উঠে পশ্চিম জার্মানি। তবে এবার জার্মানির ঘরের মাঠে। ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকের জন্য নির্মাণ করা মিউনিখে ‘অলিম্পিয়াস্তেদিওন স্টেডিয়ামে ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি হয় নেদারল্যান্ড এবং পশ্চিম জার্মানি। ডাচদের ২-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় গার্ড মুলাররা। ম্যাচের ২ মিনিটের সময় পেনাল্টি থেকে গোল করে নেদারল্যান্ডকে এগিয়ে দেন ইয়োহান নিসকেন্স। ২৫ মিনিটে জার্মানিও পেনাল্টি থেকে গোল পরিশোধ করে।

শিরোপা হাতে জার্মান অধিনায়ক; Source: fifa.com

পেনাল্টি থেকে গোল করেন পল ব্রেইটনার। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার দুই মিনিট আগে অর্থাৎ ৪৩ মিনিটে জয়সূচক গোলটি করেন গার্ড মুলার। এটি ছিলো জার্মানির দ্বিতীয় শিরোপা। এর আগে ১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরিকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতেছিলো জার্মানরা। এছাড়া ১৯৯০ এবং ২০১৪ সালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে আরও দুইবার বিশ্বকাপ জিতেছে জার্মানি।

আর্জেন্টিনা

বর্তমান সময়ে আর্জেন্টিনাকে লিওনেল মেসির দেশ হিসেবে চিনলেও। প্রথম বিশ্বকাপ থেকেই আর্জেন্টিনার প্রতাপ দেখায়। তবে তারা প্রথমবারের বিশ্বকাপ জিততে সফল হয় ১৯৭৮ সালে ঘরের মাঠে। ১৯৭৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয় নেদারল্যান্ড। নেদারল্যান্ড টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে উঠায় তাদেরকেই সবাই ফেবারিট হিসেবে ধরে নিয়েছিলো। কিন্তু নেদারল্যান্ড টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরে যায়। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের এস্তাদিও মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামে ম্যাচটি অনুষ্ঠিক হয়।

শিরোপা নিয়ে আর্জেন্টিনার উল্লাস; Source: dailystar.co.uk

এটি ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বকাপ যা অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত গড়ায়। প্রথমার্ধ ১-১ গোলে সমতা থাকার পর ম্যাচটি অতিরিক্ত সময়ে গেলে আর্জেন্টিনা ৩-১ ব্যবধানে নেদারল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নেয়। এই ম্যাচে প্রচুর পরিমাণ ফাউল হয়। আর্জেন্টিনাকে প্রথম এগিয়ে দেন মারিও কেম্পেস। এরপর ডাচদের হয়ে গোল পরিশোধ করেন ডিক নানিঙ্গা। অতিরিক্ত সময়ে মারিও কেম্পেস আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেন এবং ১১৫তম মিনিটে আর্জেন্টিনার হয়ে কফিনে শেষ পেরেকটি মারেন ড্যানিয়েল বার্তোনি। ৮ বছর পর ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা করে।

ফ্রান্স

ঘরের মাঠে সর্বশেষ বিশ্বকাপ জিতেছে ফরাসিরা। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তারা ব্রাজিলকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয়। সেইন্ট ডেনিস শহরের স্তাদে ডি ফ্রান্স স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে সেই সময়ের ৪ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে হারায় জিদানরা। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল ১৯৯৮ ফাইনালেও ফেবারিট ছিলো। কিন্তু জিদানের ফ্রান্সের কাছে তারা হেরে যায় ৩-০ গোলের ব্যবধানে।

সর্বশেষ ঘরের মাঠে শিরোপা জিতেছে ফ্রান্স; Source: fifa.com

সারা বিশ্বের কোনো ফুটবল ভক্তই ভাবতে পারেননি ফ্রান্স ব্রাজিল এত বড় ব্যবধানে হারাতে পারবে। কিন্তু জিনেদিন জিদানের দুই গোল এবং এমানুয়েল পিতিতের এক গোলে ফ্রান্স শক্তিশালী ব্রাজিলকে একদম বিধ্বস্ত করে দিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে নেয়।

Featured Image: bbc.co.uk

 

SOURCE: KHELA.CO

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *