বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা ৫টি টাইব্রেকার

0

ফিফা বিশ্বকাপের নক-আউট পর্বের সবচেয়ে জমজমাট মুহূর্ত হচ্ছে টাইব্রেকার। নক আউট পর্ব থেকে শুরু হয় এই টাইব্রেকার। যখন দুটি দল নির্ধারিত ৯০ মিনিট এবং অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে গোল ব্যবধানে এগিয়ে থেকে জয় পরাজয় নিশ্চিত করতে না পারে তখন পেনাল্টি শ্যূটআউট এর মাধ্যমে জয়-পরাজয় নির্ধারণ করা হয়। টাইব্রেকারে খেলোয়াড়, কোচ, মাঠে উপস্থিত দর্শক থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের কোটি কোটি ভক্ত স্নায়ুচাপে থাকেন। তবে বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে ম্যাচগুলোতে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মুহূর্ত এই টাইব্রেকার।

কয়েক মিনিটের উত্তেজনায় যেখানে কখনো নায়ক বনে যান গোলরক্ষকেরা এবং ভিলেন বনে যান স্পটকিক নেওয়া খেলোয়াড়রা। বিশ্বকাপের ইতিহাসে নির্ধারিত সময়ের নাটকের মতো টাইব্রেকারে অনেক সময় অনেক নাটকীয়তার দেখা গেছে। প্রায় প্রতিটি ফিফা বিশ্বকাপ অনেকগুলো নাটকীয় টাইব্রেকার উপহার দিয়ে থাকে। তা বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা পাঁচটি টাইব্রেকার নিয়ে আজকের আয়োজন। চলুন দেখে আসি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা পাঁচটি টাইব্রেকার।

পর্তুগাল বনাম ইংল্যান্ড

২০০৬ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল

২০০৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইউরোপের দেশ ইংল্যান্ড এবং পর্তুগাল। সেই সময় এই দুটি দল ধারে বারে কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে কম ছিলো। পর্তুগালের হয়ে তখন খেলতেন লুইস ফিগো, ডেকো এবং হালের সেনসেশন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের একাদশে ছিলেন ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, স্টিভেন জেরার্ড এবং ওয়েইন রুনির মত ফুটবলাররা। নির্ধারিত ৯০ মিনিট এবং অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে দুটি দলই গোলের অনেকগুলো সুযোগ সৃষ্টি করলেও শেষ পর্যন্ত গোল করতে ব্যর্থ হয়। ফলে গোলশূন্য ড্র থাকার কারণে ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। টাইব্রেকারে পর্তুগালের হয়ে প্রথম শটে সিমাও দলকে এগিয়ে দেন। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম শট নিতে আসেন ল্যাম্পার্ড। কিন্তু চেলসি মিডফিল্ডার দলের হয়ে গোল করতে ব্যর্থ হন।

ক্যারাগারের শট আটকে দিচ্ছেন পর্তুগিজ গোলরক্ষক; Source: cnn.com

ফলে পর্তুগালের সামনে সুযোগ এসে যায় এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু হুগো ভিয়ানার দ্বিতীয় শটটি আটকে দেন ইংলিশ গোলরক্ষক রবিনসন। এরপর ইংল্যান্ডের হয়ে দ্বিতীয় শট থেকে গোল করে সমতায় ফেরান ওয়েন হারগ্রিভস। পর্তুগালের হয়ে তৃতীয় শট থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন পিটিট। ফলে এবার এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায় ইংল্যান্ড।

কিন্তু স্টিভেন জেরার্ড পেনাল্টি মিস করে দলকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। কিন্তু পর্তুগালের হয়ে পোস্তিগা গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের হয়ে আবারও পেনাল্টি মিস করেন ক্যারাঘার। পর্তুগালের হয়ে শেষ শটটি নিতে আসেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। সেটি থেকে তিনি গোল করে দলকে সেমিফাইনালে নিয়ে যান।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গোলে জয় নিশ্চিত হয় পর্তুগালের; Source: gettyimages.ca

অন্যদিকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় ঘন্টা বাজে ইংলিশদের।

ব্রাজিল বনাম ফ্রান্স

১৯৮৬ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল

১৯৮৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের প্রতিনিধিত্বকারী দলটি ছিল ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি দল। ব্রাজিলের সেই দলে ছিলেন জিকো এবং সক্রেটিসের মতো ফুটবলার যাদেরকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে ফ্রান্সের একাদশে ছিলেন মিশেল প্লাতিনির মতো ফুটবলার।

পেনাল্টি মারতে যাচ্ছেন মিশেল প্লাতিনি; Source: fifa.com

১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় ব্রাজিল এবং ফ্রান্স। ম্যাচের ১৭ মিনিটেই ব্রাজিলকে এগিয়ে দেন ক্যারেকা। প্রথমার্ধ শেষ হল অল্প কিছুক্ষণ আগে মিশেল প্লাতিনি ব্রাজিলের জালে বল পাঠালেও সেটি অফসাইডের কারণে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের শেষ মুহূর্তেরগোল পরিশোধ করে ফ্রান্স। ফলে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

অতিরিক্ত সময়ে ১-১ গোলে শেষ হওয়ার পর ভাগ্য নির্ধারণের জন্য ম্যাচ চলে যায় টাইব্রেকারে। ব্রাজিলের হয়ে প্রথম পেনাল্টি শটটি নিতে আসেন সক্রেটিস। কিন্তু ফরাসি গোলরক্ষক জোয়েল ব্যাটস সক্রেটিসের শট আটকে দেন। অন্যদিকে ফ্রান্সের হয়ে প্রথম শটে গোল করেন ইসরো পায়রা। এরপরে দুই দলই সমানে সমানে লড়াই করে। কিন্তু ফ্রান্সের হয়ে মিশেল প্লাতিনি গোল করতে ব্যর্থ হন। ফলে ম্যাচে ফেরার সুযোগ পায় ব্রাজিল।

পেনাল্টি শট নিচ্ছেন জিকো; Source: footballwhispers.com

কিন্তু ব্রাজিলের জুলিও সিজার সেটিকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে ফ্রান্সের হয়ে ফার্নান্দেজ স্পটকিক থেকে গোল করে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেন এবং সেই সাথে শেষ হয় শ্বাসরুদ্ধকর টাইব্রেকার।

পশ্চিম জার্মানি বনাম ফ্রান্স

১৯৮২ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল

১৯৮২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের প্রথম বারের মতো পেনাল্টি শ্যূটআউট খেলে পশ্চিম জার্মানি এবং ফ্রান্স। নির্ধারিত ৯০ মিনিটে ১-১ গোলে সমতা থাকার পর ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমভাগেই দুই গোল করে এগিয়ে যায় ফ্রান্স। কিন্তু জার্মানি হাল ছাড়ার পাত্র নয়। ১০২ এবং ১০৮ মিনিটে রুমেনিগ এবং ফিসার গোল করে জার্মানিকে ম্যাচে ফেরান।

পেনাল্টি শট নিচ্ছে জার্মানি; Source: theguardian.com

বাকি সময়ে আর কোনো গোল না হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। ফ্রান্স এবং পশ্চিম জার্মানির হয়ে প্রথম দুইটি শট থেকেই গোল হয়। ফ্রান্সের হয়ে গোল করেন গিরেস এবং আমোরোসো। অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানির হয়ে গোল করেন পল ব্রেইটনার এবং কাল্টজ্ । প্রথম পেনাল্টি মিস করেন পশ্চিম জার্মানির স্টিলাইক। ফরাসি গোলরক্ষক জিয়ান লুক ইত্তোরি স্টিলাইকের শটটি আটকে দেন। কিন্তু ফরাসি খেলোয়াড় সিক্স দলকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হন এবং তিনিও পেনাল্টি মিস করেন।

জয়ের পর পশ্চিম জার্মানির খেলোয়াড়দের উৎসব; Source: gettyimages.ca

এরপর পশ্চিম জার্মানি টানা তিনটি পেনাল্টি শটে গোল করেন। কিন্তু ফ্রান্সের বোসিস পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হলে পশ্চিম জার্মানি ম্যাচটি ৫-৪ গোলে জিতে যায়।

ইতালি বনাম ফ্রান্স

২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনাল

ইউরোপের দুই জায়ান্ট ফ্রান্স এবং ইতালি যখনই একে অপরের মুখোমুখি হয় তখনই তারা ফুটবলভক্তদের দারুণ কিছু উপহার দেন। ফ্রান্স এবং ইতালির মধ্যে বেশকিছু জমজমাট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই ফ্রান্স এবং ইতালি ২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়। ম্যাচের ২০ মিনিটের মধ্যেই দুই দল গোল করে।

পেনাল্টি শট নিচ্ছেন আন্দ্রেয়া পিরলো; Source: mirror.co
uk

প্রথমে পেনাল্টি থেকে গোল করে ফ্রান্সকে এগিয়ে দেন জিনেদিন জিদান। এরপর মার্কো মাতেরাজ্জি আন্দ্রেয়া পিরলোর কর্নার কিক থেকে হেড করে গোল দিয়ে ইতালিকে সমতায় ফেরান। নির্ধারিত সময়ে ম্যাচটি ১-১ গোলে সমতায় থাকে। ফলে ম্যাচ চলে যায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে ফুটবল ভক্তরা বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত একটি ঘটনার স্বাক্ষী হন।

ম্যাচের ১১০ মিনিটের সময় জিনেদিন জিদান মাতেরাজ্জি বুকে ঢুঁ মেরে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন। ম্যাচের পরের সময়টুকু ফরাসিরা ১০ জন নিয়ে খেললেও ইতালি তাদের জালে বল পাঠাতে ব্যর্থ হয়। ফলে ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। টাইব্রেকারে ইতালির হয়ে প্রথম শট নেন আন্দ্রেয়া পিরলো এবং তিনি সফলভাবে বল জালে জড়ান। ফ্রান্সের উইলটোর্ড প্রথম শট থেকে গোল করে দলকে সঠিক পথেই নিয়ে যান। এরপর মার্কো মাতেরাজ্জি দ্বিতীয় স্পটকিক থেকে গোল করেন।

টাইব্রেকারে জিতে শিরোপা জয় করে ইতালি; Source: forzaitalianfootball.com

এরপর ফরাসি স্ট্রাইকার ডেভিড ট্রেজেগুয়েত ফ্রান্সের হয় দ্বিতীয় শটটি নিতে আসেন। কিন্তু তার শটটি বারে লেগে ফিরে আসে এবং ফ্রান্স পিছিয়ে পড়ে। এরপরে প্রতিটি শট থেকে উভয় দলই গোল করে। ইতালির খেলোয়াড় গ্রোসো ফরাসিদের কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে ইতালিকে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দেন।

ব্রাজিল বনাম ইতালি

১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল

১৯৭০ বিশ্বকাপ ফাইনালের পর দ্বিতীয়বারের মতো আবারো বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইতালি এবং ব্রাজিল। ইতালি এবং ব্রাজিল তখন বিশ্বের সবচেয়ে সফল দুটি দল এবং দুটি দলই তিনবার করে মোট ছয়বার বিশ্বকাপ জিতেছে।

পেনাল্টি মিস করেন রবার্ট বাগিও; Source: thenational.ae

তাই এবার যে দলটি জিতবে সেটি হবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বার বিশ্বকাপ জয়ী দল। নির্ধারিত ৯০ মিনিট এবং অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে কোনো দল গোল করতে না পারায় ম্যাচটি গড়ায় পেনাল্টি শ্যূটআউটে। মার্সিও সান্তোস ব্রাজিলের হয়ে প্রথম শটটি নেন। কিন্তু তখনই নাটকীয়তার শুরু। তিনি প্রথম শট থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন।

ফ্রাঙ্কো বারেসি ইতালির হয়ে প্রথম শট থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন। এর পরের তিনটি শটে ব্রাজিলের পক্ষে রোমারিও, ব্রাঙ্কো এবং দুঙ্গা সফলভাবে গোল করেন। কিন্তু ইতালির মাসারো পেনাল্টি থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন। ফলে ব্রাজিল ৩-২ গোলে এগিয়ে যায়। এরপর ইতালির হয়ে শেষ শটটি নিতে আসেন পুরো বিশ্বকাপে ইতালির হয়ে দারুন খেলা রবার্তো বাগিও

পেনাল্টি শট ঠোকাচ্ছেন ব্রাজিলেরর গোলরক্ষক; Source: gettyimages.com

ম্যাচে টিকে থাকার জন্য তাকে অবশ্যই গোল করতে হতো। কিন্তু রবার্তো বাগিও শেষ পেনাল্টি মিস করেন। ফলে টাইব্রেকারে ইতালিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেয় ব্রাজিল।

Featured Image: gettyimages.ca

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *