বিশ্বকাপে গোলরক্ষকদের করা ১০টি সাংঘাতিক ভুল

0

ফুটবলে প্রতিটি দলের গোলপোস্টের নিচে সজাগ প্রহরী গোলরক্ষক। পৃথিবীর প্রতিটি গোলরক্ষককে সেই দেশের সমর্থক থেকে শুরু করে সতীর্থরা চান যেন তিনি গোল পোস্টের নিচে দূর্গের মতো হয়ে দলকে রক্ষা করেন। দলের ডিফেন্ডাররা যখন প্রতিপক্ষের খেলেয়াড়দের আটকাতে ব্যর্থ তখন সব দায়িত্ব এসে বর্তায় গোলরক্ষকের উপর। তখন অতি মানবীয় কিছু করে দেশ এবং ফুটবল বিশ্বের কাছে নায়ক বনে যান। কিন্তু গোলরক্ষকদের কিছু কিছু ভুলের কারণে দলকে মাশুল দিতে। আর সেটি যদি হয় বিশ্বকাপের মতো, তাহলে তো কথাই নেই। দলের সাথে সাথে নিজের ক্যারিয়ারও ধ্বংসের মুখে পড়ে যায়। যার প্রমাণ আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক কাবায়েরোর। এক ভুলের কারণে তাকে মাশুল দিতে হচ্ছে। তবে এমন সাংঘাতিক ভুল যে শুধু কাবায়েরো প্রথম করেছেন, সেটাও নয়। বিশ্বের অনেক নামকরা গোলরক্ষকও সাংঘাতিক ভুল করেছেন। সেই ভুলগুলো নিয়ে আজকের আয়োজন।

বারবোসা
ফলাফল: ব্রাজিল ১-২ উরুগুয়ে
১৯৫০ বিশ্বকাপ ফাইনাল

১৯৫০ বিশ্বকাপ ফাইনাল ফুটবল ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে ‘মারাকানাজো’ নামে। ঘরের মাঠে উরুগুয়ের বিপক্ষে সেদিনের জনসমুদ্রের সামনে ব্রাজিল ড্র করলেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয় করতে পারতো। ব্রাজিলের দর্শক থেকে শুরু করে সবাই ধরে নিয়েছিলো ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিততে চলেছে। ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই ব্রাজিলের ‘ও মুন্ডো’ পত্রিকা ব্রাজিলের বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা দলের ছবি দিয়ে খবর ছাঁপানো শুরু করে। পত্রিকাটি লেখে ‘ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন‘।

 

ঘিঘিয়ার সেই গোল; Source: sport360@gmail.com

মারাকানা স্টেডিয়ামে সেদিন দারুণভাবে শুরু করে ব্রাজিল। ৪৬ মিনিটে ব্রাজিলকে এগিয়ে দেন ফ্রিয়াকা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের মাঝখানে এসি মিলানে কিংবদন্তী ফুটবলার হুয়ান শিয়াফিনো উরুগুয়েকে সমতায় ফেরান। এতেও ব্রাজিলের কোনো সমস্যা ছিলো না। কারণ ড্র করতে পারলেও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে তারা। কিন্তু ব্রাজিলের সব স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে যায় ৭৯ মিনিটে আলসিদেস ঘিঘিয়ার গোলে। ঘিঘিয়া প্রথমে ব্রাজিলের ডিফেন্ডার বিগোদকে ড্রিবল করেন। ব্রাজিলের গোলরক্ষক বারবোসা ভেবেছিলেন ঘিঘিয়া ক্রস করবেন। কিন্তু ঘিঘিয়া বল মারেন গোলপোস্টের একদম ঘেষে। উরুগুয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় কিন্তু বারবোসা পান আমৃত্যু অপরাধীর খেতাব। ২০০০ সালে মৃত্যুর আগে বারবোসা বলেন,”ব্রাজিলের আইনে সর্বোচ্চ জেল ৩০ বছর। কিন্তু আমি জেল খাটছি ৫০ বছর ধরে।”

নেরি পামপিদো
ফলাফল: আর্জেন্টিনা ০-১ ক্যামেরুন
১৯৯০ বিশ্বকাপ প্রথম রাউন্ড

১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনা পরের বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই হোঁচট খায় ক্যামেরুনের কাছে। ১৯৯০ সালের গ্রুপ পর্বে ক্যামেরুনের বিপক্ষে ম্যাচটি সারা জীবনের দুঃস্বপ্ন হয়ে রয়েছে আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক নেরি পামপিদোর কাছে। তার ভুলের কারণে আর্জেন্টিনা ক্যামেরুনের কাছে ১-০ গোলে হেরে যায়।

নেরি পামপিদোর সেই ভুল; Source: gettyimages.com

ফ্রাঙ্কোইস ওমাম-বিয়িকের হেডটি ছিলো খুবই দূর্বল। সেটা থেকে যে গোল হতে পারে কেউ কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক পামপিদোর হাত ফসকে বলটি জালে জড়ায়। পরের ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে তার পা ভেঙে যাওয়ায় তার বদলি হিসেবে খেলানো হয় সার্জিও গয়কোচিয়া। সার্জিও গয়কোচিয়া পরবর্তীতে স্বাগতিক ইতালি এবং যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি শ্যূটআউটে পেনাল্টি ঠেকিয়ে জাতীয় নায়ক বনে যান।

রেনে হিগুইতা
ফলাফল: কলম্বিয়া ১-২ ক্যামেরুন
১৯৯০ বিশ্বকাপ দ্বিতীয় রাউন্ড

বিশ্ব ফুটবলে যদি খ্যাপাটে গোলকিপারের তালিকা করা হয়, তাহলে রেনে হিগুইতাকে কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারবেন না। তিনি প্রায় ম্যাচেই বল নিয়ে বক্স ছেড়ে বের হয়ে আসতেন, প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের তার পিছনে ঘুরাতেন। আবার কখনো কখনো তিনি বক্স ছেড়ে মাঝমাঠ পর্যন্ত চলে আসতেন।

রেনে হিগুইতার সেই ভুল; Source: fifa.com

কিন্তু সব দিন একইভাবে যায় না। ১৯৯০ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে ক্যামেরুনের বিপক্ষে তার পাগলামির মূল্য দিতে হয় পুরো দলকে। ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে হিগুইতা মাঝমাঠের কাছাকাছি আসলে রজার মিলা তার কাছে থেকে বল কেড়ে নেন। রজার মিলা ফাঁকা পোস্টে বল জড়িয়ে ক্যামেরুনকে কোয়ার্টার ফাইনালে তুলেন। অন্যদিকে হিগুইতা খলনায়ক বনে যান।

প্যাট বোনার
ফলাফল: আয়ারল্যান্ড ০-২ নেদারল্যান্ড
১৯৯৪ বিশ্বকাপ দ্বিতীয় রাউন্ড

১৯৯৪ বিশ্বকাপে ‘গ্রুপ অব ডেথ’ এ পড়ে আয়ারল্যান্ড। কিন্তু সেই কঠিন গ্রুপে অ্যারিগো সাচ্চির শক্তিশালী ইতালিকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় আয়ারল্যান্ড। দ্বিতীয় রাউন্ডে জ্যাক চার্লটনের আয়ারল্যান্ড মুখোমুখি হয় নেদারল্যান্ডের।

হতাশ প্যাট বোনার ; Source: the42.ie

কিন্তু ডিফেন্ডারদের দুইটি ভুলের কারণে মূল্য দিতে আইরিশদের। ১-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পর ৩০ গজ দূর থেকে উইম জঙ্কের নেওয়া সহজ শট আটকাতে ব্যর্থ হন আইরিশ গোলরক্ষক প্যাট বোনার।

ডেভিড সিম্যান
ফলাফল: ইংল্যান্ড ১-২ ব্রাজিল
২০০২ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল

রোনালদিনহো তার ফুটবল ক্যারিয়ারে অসংখ্য চোঁখ ধাঁধানো গোল করেছেন। যার মধ্যে অন্যতম একটি ছিলো ২০০২ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা গোলটি। যদিও দূরপাল্লার শটে করা গোলটি অসাধারণ ছিলো তবু ইংলিশ গোলরক্ষকের উচিত ছিলো গোলটি আটকানো।

বল জড়াচ্ছে সেটি দেখছেন ডেভিড সিম্যান; Source: telegraph.co.uk

কিন্তু ৪০ গজ দূর থেকে রোনালদো যখন শট তখন ডেভিড সিম্যান গোললাইন থেকে তিন গজ এগিয়ে আসেন। রোনালদিনহোর শটটি তাকে বোকা বানিয়ে দিয়ে গোল পোস্টে ঢুকে যায়।

অলিভার কান
ফলাফল: জার্মানি ০-২ ব্রাজিল
২০০২ বিশ্বকাপ ফাইনাল

অলিভার কানের নাম এবং সালটি দেখে হয়তো অবাক হচ্ছেন। অবাক হওয়ারই কথা। অলিভার কান ২০০২ বিশ্বকাপে শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক ছিলেন না, সেই সাথে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ও ছিলেন। আগের বছর তিনি বায়ার্নের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন এবং জার্মানির হয়েও প্রায় অপরাজেয় ছিলেন।

হতাশ অলিভার কান; Source: thesefootballtimes.com

২০০২ বিশ্বকাপ ফাইনালে ৬৭ মিনিট পর্যন্ত তিনি জার্মানির গোলপোস্ট অক্ষত রাখেন। কিন্তু এরপরই রিভালদোর একটি শট ঠেকানোর পর সেটি তার হাত ফসকে বের হয়ে যায়। সেটি থেকে গোল করেন রোনালদো। কয়েক মিনিট পরে রোনালদো দ্বিতীয় গোল করে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দেন।

রব গিন
ফলাফল: ইংল্যান্ড ১-১ যুক্তরাষ্ট্র
২০১০ বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্ব

২০১০ সালে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড দারুণ শুরু করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ১-১ গোলে ড্র করার পরই বদলে যায় দলটি। ইংল্যান্ড কোচ ফ্যাবিও ক্যাপেলো জো হার্টকে বসিয়ে রব গ্রিনকে মাঠের নামান। কিন্তু রব গ্রিন কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হোন। খুব বাজেভাবে একটি গোল হজম করেন তিনি।

রব গ্রিনের সেই ভুল; Source: dailymail.co.uk

বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া ক্লিন্ট ডেম্পেসির শট মাটিতে ড্রপ করে তার কাছে আসে, তবু সেটি তার হাত ফসকে জালে জড়ায়। এই ম্যাচের পর ইংল্যান্ড কোনো রকমে গ্রুপ পর্ব পার হয় কিন্তু নক-আউট পর্বে জার্মানির কাছে ৪-১ গোলে হেরে বিদায় নেয়।

ইগর আকিনফিয়েভ
ফলাফল: রাশিয়া ১-১ দক্ষিণ কোরিয়া
২০১৪ বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্ব

২০১৪ বিশ্বকাপে রাশিয়ার সামনে সুযোগ ছিলো দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার। তাদের গ্রুপে শক্তিশালী দল ছিলো শুধুমাত্র বেলজিয়াম। বাকি দুই দলের সাথে তাদের জয়ের সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে রুশ গোলরক্ষক আকিনফিয়েভ মস্ত বড় ভুল করে বসেন।

ইগর আকিনফিয়েভের সেই ভুল; Source: irishtimes.com

২০ গজ দূর থেকে নেওয়া লি-কিউন-হোর শটটি অনায়াসে ঠেকাতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি করতে ব্যর্থ হোন। রাশিয়া খুব তাড়াতাড়ি গোল শোধ করে কিন্তু ম্যাচটি জিততে ব্যর্থ হয়। এরপর আলজেরিয়ার সাথে ড্র করে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয় রাশিয়া।

ডেভিড ডি গিয়া
ফলাফল: পর্তুগাল ৩-৩ স্পেন
২০১৮ বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্ব

বিশ্বের অন্যতম সেরা গোলকিপার হিসেবে রাশিয়াতে আসেন স্প্যানিশ গোলরক্ষক ডেভিড ডি গিয়া। কিন্তু রাশিয়াতে এসে তিনি মস্ত বড় ভুল করে ফেলেন পর্তুগালের বিপক্ষে।

ডেভিড ডি গিয়ার ভুল; Source: buisnessinsider.com

৪ মিনিটে পেনাল্টি থেকে পর্তুগালকে এগিয়ে দেন রোনালদো। এরপর স্পেন গোল শোধ করে সমতায় ফেরে। কিন্তু এরপর রোনালদোর নিচু একটি শট আটকাতে ব্যর্থ হন ডেভিড ডি গিয়া।

উইলি কাবায়েরো
ফলাফল: আর্জেন্টিনা ০-৩ ক্রোয়েশিয়া
২০১৮ বিশ্বকাপ গ্রুপপর্ব

২০১৮ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে পয়েন্ট হারায় আর্জেন্টিনা। তাই দ্বিতীয় ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার জয়ের কোনো বিকল্প ছিলো। প্রথমার্ধ গোলশূণ্য থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধে উইলি কাবায়েরো ক্রোটদের গোল উপহার দেন।

উইলি কাবায়েরো; Source: express.co.uk

দ্বিতীয়ার্ধের ৮ মিনিটের সময় গ্যাব্রিয়েল মারকাদো ব্যাকপাস করেন কাবায়েরোকে। কিন্তু কাবায়েরো বলটি ক্লিয়ার করতে গিয়ে এমনভাবে ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড় আন্তে রেবিচের সামনে হাওয়ায় তুলে দিলেন যেটা থেকে গোল করতে কোনো ভুল হয়নি ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলারের।

 

Featured Image: thesefootballtimes.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *