দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু অদম্য সাহসিকতার গল্প

Source: War History

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিলো বিশ্বের সবথেকে রক্তাক্ত ইতিহাসময় ঘটনা। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ থেকে ১৯৪৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ছয় বছর ১ দিন ছিলো এই যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল। দুইপক্ষের প্রায় দুই কোটি চল্লিশ লাখ সৈনিক আর চার কোটি ঊনপঞ্চাশ লাখের মত সাধারণ জনগণ এই যুদ্ধে মারা গিয়েছিলো। তবে সংখ্যাটা আরো বড় হতো যদিনা কিছু সাহসী মানুষ অসংখ্য মানুষের জীবন রক্ষা না করতো। তেমন কিছু সাহসী মানুষের দুঃসাহসিক কিছু ঘটনা নিয়ে আমাদের এই ফিচার।

১. সোহাম রেলওয়ের বিস্ফোরণ

সময়টা ১৯৪৪ সালের জুন মাসের দুই তারিখ। ড্রাইভার বেঞ্জামিন গিলবার্ট ও তার ফায়ারম্যান জেমস নাইটাল একটি মালবাহী ট্রেনের দায়িত্বে ছিলেন। যেটা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট ক্লোনের ইউএসএএফে উদ্যেশ্যে প্রায় চারশো টন বিস্ফোরক নিয়ে যাচ্ছিলো।

তারা যখন সোহামের ট্রেন স্টেশনের কাছাকাছি যেটা কিনা একটা গ্রামীণ রেলওয়ে স্টেশন, তখন বেঞ্জামিন আবিষ্কার করলেন তাদের একটি বগির লোকোমোটিভে (লোকোমোটিভ ট্রেনের ইঞ্জিনের একটি একটি অংশ যেটা কিনা ট্রেনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়) আগুন লেগেছে। তারা সাথে সাথে দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন কারন ওই বগিতেও ছিলো প্রায় ২২৭ কেজি বিস্ফোরক।

Source: War History

নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে বেঞ্জামিন ট্রেনটি দ্রুত থামালেন। আর নাইটালের সহায়তায় অন্যান্য বগিগুলোকে খুলে দিয়ে আগুন লেগে যাওয়া বগিটিকে ইঞ্জিন লাগিয়ে দ্রুতগতিতে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। তবে তিনি বেশিদূর নিয়ে যেতে পারেননি। স্টেশনের ১২৮ মিটার দূরত্বে থাকতেই বিস্ফোরণটি ঘটে। আর সেই বিস্ফোরণের ফলে সাথে সাথে নাইটাল মারা যায় এবং সেখানকার সিগনালম্যান ফ্যাঙ্ক ভয়াবহ আহত হয়। যদিও সেই সিগনালম্যান পরবর্তী দিনেই মৃত্যুবরন করেছিলো। তবে বেঞ্জামিন গুরুতর আহত হলেও বেঁচে গিয়েছিলো।

Source: War History

তাদের সাহসিকতার দরুন পুরো গ্রামের সবাই বেঁচে গিয়েছিলো। যদিও ছয়শোর মত বাড়িঘরের কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো আর সোহাম স্টেশন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। তাদের এই সাহসিকতার জন্য বেঞ্জামিন জর্জ ক্রস এওয়ার্ড পেয়েছিলেন। যেটা কিনা অসামরিক কাজের সর্বোচ্চ সম্মাননা।

২. অপারেশন জেরিকো

১৯৪৪ সনের ফেব্রুয়ারির ঘটনা। রয়াল এয়ার ফোর্স, রয়াল নিউজিল্যান্ড এয়ার ফোর্স আর রয়াল অস্ট্রেলিয়ান এয়ারফোর্সের মিলিত মস্কিউটো বোম্বার ফাইটার এয়ারক্র্যাফটের স্কোয়াডকে একটি মিশন দেওয়া হওয়া। তাদের মিশন ছিলো ফ্রান্সের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত আমিয়েন কারাগারে আক্রমণ করা। এবং সেখানকার সাতশো ফ্রান্সের বিরোধী যোদ্ধাকে মুক্ত করা। যেটা কিনা ছিলো প্রায় অসম্ভব কাজের কাছাকাছি, কারণ একে তো ইংলিশ চ্যানেল তাদের পারি দিতে হবে, দ্বিতীয়ত আবহাওয়া অবস্থা ছিলো ভয়াবহ খারাপ।

Source: War History

অর্ডার পাওয়ার পর ১৮ টি মস্কিউটো বোম্বার ফাইটার আমিয়েন কারাগারের উদ্যেশ্যে রওয়ানা দেয়। ইংলিশ চ্যানেল পারি দেওয়ার সময়ে রাডার ফাকি দিতে সমুদ্রের ঢেউ থেকে মাত্র পঞ্চাশ ফুট উপরে উড়তে হয়েছিলো তাদের। তাদের আঠারো জনের মধ্যে তের জন শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন চার্লসের নির্দশনার আক্রমণ শুরু করে।

তাদের আক্রমণ শুরু হয়েছিলো ঠিক দুপুর বারোটা এক মিনিটে। প্রথমে তারা কারাগারের দেয়াল ভেঙে কয়েদিদের পালানোর ব্যবস্থা করে দেয় আর জার্মান অফিসারদের পোস্ট গার্ডে আক্রমণ করে গুঁড়িয়ে দেয়। এরপর তারা সেখানকার জার্মান দখলকৃত ট্রেন স্টেশন আক্রমণ করে।

Source: War History

এই মিশনের ফলে প্রায় আমিয়েন কারাগার হতে আড়াইশো কয়েদি পালাতে সক্ষম হয়েছিলো। একশো বিশ জন জার্মানদের হাতে নিহত হয় এবং পুনরায় বন্দি হয় দেড়শো জনের মত। আর মস্কিউটো স্কোয়াড্রন হারিয়েছিলো তাদের দুই বিমান যার একটিতে ছিলো গ্রুপ ক্যাপ্টেন চার্লস। কে বা কারা এই আক্রমণে নির্দেশ দিয়েছিলো সেটা আজও রহস্য হয়ে রয়েছে।

৩. ক্যাপ্টেন চার্লস উপহাম

ব্রিটিশ আর কমনওয়েলথ আর্মির সর্বোচ্চ সম্মাননা ধরা হয় ভিক্টোরিয়া ক্রস কে। যেটা কিনা সর্বমোট এক হাজার তিনশত সাতান্ন বার প্রদান করা হয়েছে। আর এর মধ্যে মাত্র তিনজন ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এই সম্মাননা অর্জন করছিলো। আর তিনজনের মধ্যে একজন হচ্ছেন ক্যাপ্টেন চার্লস উপহাম। যিনি কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতেই দুইবার এই সম্মাননা অর্জন করেছিলেন।

Source: War History

১৯৩৯ সনে তিনি নিউজিল্যান্ড আর্মিতে নিজের ইচ্ছেতেই যোগদান করেন আর একই বছরেই কমিশন অফিসারে উত্তীর্ণ হন। ৪১ সনের মে মাসের জার্মানদের বহিরাক্রমনে তার বিরত্বের জন্য প্রথম ভিক্টোরিয়া ক্রশ প্রাপ্ত হন।

তিনি তার প্লাটুন নিয়ে জার্মানদের ঘাটি আক্রমণ করেন। যেটা কিনা ছিলো প্রায় তিন কিলোমিটার বিস্তৃত। সেই আক্রমনে তিনি একাই দুইটি মেশিনগান নেস্ট আর একটি এন্টি এয়ারক্র্যাফট আর্টিলারি ধ্বংস করেন শুধুমাত্র গ্রেনেড দিয়ে। এরপর ত্রিশ মে তে তিনি তার প্লাটুন নিয়ে জার্মানদের অগ্রসরমান সৈন্যদলকে আক্রমণ করেন আর ব্রায়ান মেশিন গান ব্যবহার করে বাইশজনকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এছাড়া সেই যুদ্ধে তিনি একাধিক আহত সহযোদ্ধাদের বহন করে নিয়ে আসেন আর তাদের প্রান রক্ষা করেন।

Source: War History

তিনি তার দ্বিতীয় ভিক্টোরিয়া ক্রস অর্জন করের পরবর্তী বছরের জুলাইয়ের পঁচিশ তারিখে। তখন তারা প্রথমবারের মত ইএল এলামিনে আক্রমণ করেছিলেন। সেখানে রুয়েইজ্যাট রিজে তখন ভয়াবহ ভাবে জার্মান সৈন্যরা প্রতিরোধ করছিলো যার কারনে নিউজিল্যান্ডের আর্মিরা কিছুতেই সামনে এগুতে পারছিলো না। তখন চার্লস দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নেন। তিনি মেশিন গানের মুহুমুহু গুলির মধ্যে গ্রেনেডের ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে যান আর সেগুলো ছুড়ে দেন জার্মান সৈন্যদের গাড়ির বেড়িগেডের উদ্যেশ্য।

এরপর তিনি একটি জার্মান জিপ দখল করেন আর সেটা নিয়ে সরাসরি আক্রমণ করেন শত্রুপক্ষের উপর। তিনি শত্রুপক্ষের প্রতিরোধ পিছু হটাতে পারলেও জার্মান সেনাদের মধ্যে একা হয়ে পড়েন। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে তিনি শুধু বেয়োনেট চার্জ করে শত্রুপক্ষের একাধিক সৈন্যদের কতল করেন। কনুইতে গুলি আর হাত ভাঙার পরও তখনো তিনি লড়াই করে গিয়েছিলেন।

Source: War History

উপহাম তার বীরত্বের ব্যাপারের সর্বদাই নিশ্চুপ ছিলেন। তার সাহসিকতার ব্যাপারে যখন রিপোর্টারা জানতে চেয়েছিলো তখন তিনি বলেছিলেন, “হ্যাঁ আমি নিজের কাজের জন্য কিছুটা গর্ববোধ করি সত্য, তবে যুদ্ধের ময়দানে আমার থেকে বেশি সাহসিকতার কাজ করেছে এমন আরো শ’খানেক লোককে আমি দেখাতে পারবো। তাদের কাছে আমার কাজ কিছুই নয়।”

৮৬ বছর বয়সে ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে এই বীর চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *