নেতৃত্ব প্রদানকারী নেতার বা উদ্যোগতার এমন একটি গুণ যা তার ভিতরের উদ্যমশীলতাকে তাঁর দলের মধ্যে সঞ্চালিত করে দলের উদ্যমশীলতাকে জাগিয়ে তোলে।

 

নেতৃত্ব হল এমন এক “সামাজিক প্রভাবের প্রক্রিয়া যার সাহায্যে মানুষ কোনও একটি সর্বজনীন কাজ সম্পন্ন করার জন্য অন্যান্য মানুষের সহায়তা ও সমর্থন লাভ করতে পারে।”  জীনতত্ত্ববিদ এলান কিত আরও সর্বব্যাপী একটি সংজ্ঞা দেন। তিনি বলেন, “নেতৃত্ব হল মানুষের জন্য একটি পথ খুলে দেওয়া যাতে তারা কোনও অসাধারণ ঘটনা ঘটানোর ক্ষেত্রে নিজেদের অবদান রাখতে পারে।” কেন অগবন্নিয়ার (২০০৭) কথায় “প্রাতিষ্ঠানিক বা সামাজিক লক্ষে পৌঁছনোর জন্য অন্তর্বর্তী ও বাহ্যিক পরিবেশে প্রাপ্ত সম্পদকে সফলভাবে সমন্বয় সাধন করাও তা থেকে সর্বাধিক লাভ তোলার ক্ষমতাই হল কার্যকরী নেতৃত্ব।” কার্যকর নেতার সংজ্ঞা অগবন্নিয়া দেন এভাবে, “যে কোনও পরিস্থিতিতে যে ব্যক্তি ধারাবাহিকভাবে সফল হওয়ার ক্ষমতা রাখেন এবং কোনও সংস্থা বা সমাজের প্রত্যাশা পূরণকারী হিসেবে স্বীকৃতি পান”, তিনিই কার্যকর নেতা।

প্রতিষ্ঠানগত অনুষঙ্গে তার অন্যতম প্রাসঙ্গিক দিক হল নেতৃত্ব। কিন্তু নেতৃত্বের সঠিক সংজ্ঞা দেওয়া বেশ কঠিন। লিংকন ইউনিভাসিটির সহকারী অধ্যাপক এন মেরি ই ম্যাকসোয়েনের মতে, “নেতৃত্ব আসলে ক্ষমতা। নেতাদের শোনার ও পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা, সব স্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আলোচনা শুরু করায় উৎসাহদানের জন্য নিজেদের দক্ষতাকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতা, জোর করে চাপিয়ে না দিয়ে নিজেদের মূল্যবোধ ও দূরদর্শিতাকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা। নেতৃত্ব মানে শুধুই সভায় আলোচ্য বিষয়সূচির প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখানো নয়, নিজে সেই কর্মসূচি স্থির করা, সমস্যা চিহ্নিত করা এবং শুধুই পরিবর্তনের সঙ্গে সামাল দিয়ে না চলে নিজেই এমন পরিবর্তনের সূচনা করা যা উল্লেখযোগ্য উন্নতির পথ প্রশস্ত করে।”

 

পরবর্তী বিভাগগুলিতে নেতৃত্বের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। নেতৃত্ব কী এবং নেতৃত্বকে ঘিরে বেশ কিছু প্রচলিত তত্ত্ব এবং শৈলীর বিবরণও এই আলোচনার অন্তর্গত। আবেগ ও দূরদৃষ্টির ভূমিকা এবং নেতৃত্বের কার্যকারিতা ও কার্য সম্পাদন, বিভিন্ন অনুষঙ্গে নেতৃত্বের ধারণা, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ধারণার থেকে এটি কীভাবে আলাদা, এবং সাধারণভাবে নেতৃত্বের কিছু সমালোচনা।

নেতৃত্ব বিষয়টি নিয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীরা নেতৃত্ব সম্পর্কে অনেকগুলি তত্ত্বের জন্ম দিয়েছেন। বৈশিষ্ট, অবস্থাভেদে পারস্পরিক যোগস্থাপন, ব্যবহার, ক্ষমতা, দূরদৃষ্টি ও মূল্যবোধ, সহজাত দক্ষতা এবং বুদ্ধিমত্তা তাদের অন্যতম।কার্যকরী নেতৃত্বের সঙ্গে জড়িত নানা ধরনের ব্যবহার ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করে বৈশিষ্ট্যতত্ত্ব।

 

বৈশিষ্ট্য তত্ত্বের প্রবক্তারা সাধারণত নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলিকে তালিকাবদ্ধ করে রাখেন। তাঁরা ধরে নেন যে কোনও নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণই কার্যকর নেতৃত্ব দানের ক্ষমতায় পৌঁছতে সাহায্য করে। শেলি কার্কপ্যাট্রিক এবং এডুইন এ. লক (১৯৯১) বৈশিষ্ট্য তত্ত্বের উদাহরণ দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, “নেতৃত্বের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল চালনাশক্তি (একটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত শব্দ যার অন্তর্ভুক্ত হল কৃতিত্ব,প্রেরণা, উচ্চাশা, প্রানশক্তি, উদ্যোগ এবং লেগে থাকার ক্ষমতা), নেতৃত্বের প্রেরণা (নেতৃত্ব দানের ইচ্ছা কিন্তু ক্ষমতা লাভকেই লক্ষ্য হিসেবে দেখা নয়), সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আত্মবিশ্বাস (যা আবেগের স্থৈর্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত), অনুধাবনের ক্ষমতা এবং ব্যবসায়িক জ্ঞান। তাঁদের গবেষণা অনুসারে, “সহজাত দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং নমনীয়তার মতো বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ তত স্পষ্ট নয়।”

কার্যকরী নেতৃত্বের সঙ্গে জড়িত নানা ধরনের ব্যবহার ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করে বৈশিষ্ট্যতত্ত্ব। এটিই সম্ভবত নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রথম পুঁথিগত তত্ত্ব। বৈশিষ্ট্য তত্ত্বের অন্যতম পথিকৃৎ হলেন টমাস কার্লাইল (১৮৪১)। ক্ষমমতায় উন্নীত ব্যক্তির প্রতিভা, দক্ষতা এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করার জন্য তিনি এমন একটি তত্ত্বের ব্যবহার করেছেন। রোনাল্ড হেইফেজ (১৯৯৪) বৈশিষ্ট্য তত্ত্বের মধ্যে উনিশ শতকের ছায়া খুঁজে পেয়েছেন, যখন মহান ও বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের জীবন-ইতিহাসের সঙ্গে সমাজের ইতিহাসকেও যুক্ত করা হত।

 

বিশেষ কোনও কাজ সম্পাদন এবং দলের কাজের জন্য তাকে পুরস্কার বা শাস্তি দানের ক্ষমতা সম্পাদনামূলক নেতার (বার্নস, ১৯৭৮) হাতে থাকে। তা ব্যবস্থাপককে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দেয় এবং দলও অন্য কোনও কিছুর বিনিময়ে একটি পূর্ব-নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য তাঁর নেতৃত্ব অনুসরণ করতে সম্মত হয়। উত্পাদনশীলতা সন্তুষ্টির পর্যায়ে না পৌঁছলে নেতাকে অধস্তনদের মূল্যায়ন করা, সংশোধন করা ও প্রশিক্ষণ দানের ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং আশানুরূপ ফলাফলে পৌঁছনো গেলে তখন সেই কার্যকারিতাকে পুরস্কার প্রদানের ক্ষমতাও নেতাকে দেওয়া হয়।

সম্পাদনামূলক নেতা (বার্নস, ১৯৭৮) তাঁর দলকে কার্যকরী ও দক্ষ হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য যোগাযোগই সেরা মাধ্যম, তা দলকে শেষ ঈপ্সিত ফলাফল বা লক্ষ্য প্রাপ্তির বিষয়ে মন নিবদ্ধ করতে সাহায্য করে। এই নেতা অত্যন্ত বেশি মাত্রায় দৃষ্টিগোচর এবং কাজ শেষ করার জন্য তিনি একটি নির্দেশ-শৃঙ্খল ব্যবহার করেন। সম্পাদনামূলক নেতা বৃহত্তর ছবির প্রতি মন নিবদ্ধ করেন, এবং তাঁকে ঘিরে থাকেন একদল মানুষ যাঁরা বাকি খুঁটিনাটির দায়িত্ব নেন। নেতা সর্বদাই নতুন নতুন চিন্তার খোঁজে থাকেন যা প্রতিষ্ঠানকে সংস্থার কল্পিত পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করে।

 

সর্বোপরি গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব শৈলীতে দলের সিদ্ধান্ত-গ্রহণকেই পছন্দ করা হয়, অর্থাত্ এই নেতা দলের সঙ্গে প্রথমে আলোচনা করে তার পর নির্দেশ দেন। তিনি দলের সহযোগিতা লাভ করতে পারেন এবং দলকে কার্যকরী ও ইতিবাচকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। গণতান্ত্রিক নেতার সিদ্ধান্ত দলের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা ও তাঁদের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে।

নেতার নেতৃত্ব যত সুগঠিত হয় দলের ফলাফল ততই আশানুরূপ হয় এবং একটা সময়পর তা নিদিষ্ট লক্ষে পৌঁছায়।