বিস্ময়কর এক পদার্থের নাম গ্রাফিন যা ১০ টি উপায়ে পৃথিবীর দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষ এমন সব নিত্যনতুন বিষয় আবিষ্কার করে চলছে। এর মধ্যে কোনো কোনো আবিষ্কার পৃথিবীর চিত্রই  পরিবর্তন করে ফেলছে। বিশ্বকে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে এমন এক পদার্থ আবিষ্কৃত হয়েছে ২০০৪ সালে যার নাম গ্রাফিন।  কার্বনের একটি ভিন্ন রূপ গ্রাফাইট যা বিদ্যুৎ পরিবাহী ও পেনসিলের শিসে ব্যবহৃত হয়। এই গ্রাফাইটকেই আরেকটু পরিবর্তন করে তৈরি করা হয়েছে গ্রাফিন। ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির দুই প্রথিতযশা বিজ্ঞানী অধ্যাপক স্যার আন্দ্রে গেইম ও অধ্যাপক স্যার কন্সটান্টিন নভোসেলভ এই গ্রাফিনকে নতুন ও পৃথক পদার্থ হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন যা তাদের দুজনকে নোবেল জয়ের সম্মান এনে দেয়।

Source: nusteelfab.com

গ্রাফিনের অণু অনেক ছোট ও খুবই স্বচ্ছ আর একই সঙ্গে এর কাঠামো খুব শক্তিশালী। গ্রাফিনকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম দ্বিমাত্রিক পদার্থ যে মাত্র এক পরমাণু পুরুত্ব নিয়েও সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর এই দ্বিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য গ্রাফিনকে বিদ্যুৎ পরিবাহিতার ক্ষেত্রে করেছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কপারের চেয়েও গ্রাফিন কয়েক লক্ষ গুণ বেশি বিদ্যুৎ পরিবাহী। বলা হয়ে থাকে, গ্রাফিনের এক গ্রামেরও কম ভরের এক পরমাণু পুরু একটি স্তর দিয়ে পুরো একটা ক্রিকেট মাঠকে ঢেকে দেওয়া যাবে। শুধু এগুলোই নয়, গ্রাফিন বেশ হালকা  পদার্থ। এক বর্গ সেন্টিমিটার গ্রাফিন এরোজেলের ভর প্রায় ০.১৬ মিলিগ্রাম। তবে এটি ইস্পাতের চেয়ে প্রায় দুইশত গুণ বেশি শক্তিশালী। গ্রাফিন বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। উল্লেখযোগ্য যে ১০ উপায়ে গ্রাফিনকে ব্যবহার করে মানুষের জীবনযাপনে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব সেগুলো নিয়ে আজকের এই আলোচনা।

১. বায়ু থেকে জ্বালানি সংগ্রহ

গ্রাফিনকে পৃথককারী বিজ্ঞানী অধ্যাপক স্যার আন্দ্রে গেইম ও অধ্যাপক স্যার কন্সটান্টিন নভোসেলভ বলেন যে, বায়ু থেকে নির্গত হাইড্রোজেন দ্বারা পরিচালিত মোবাইল ইলেক্ট্রিক জেনারেটর তৈরিতে গ্রাফিন ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও গ্রাফিন প্রোটন পরিচালিত ঝিল্লির কার্যকারিতা উন্নত করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হতে পারে। এই প্রোটন জ্বালানি সেল প্রযুক্তির অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। এভাবে গ্রাফিন ব্যবহার করে বায়ু থেকে পরিশোধিত অল্প পরিমাণ হাইড্রোজেন দ্বারাই যানবাহন চালানো সম্ভব। যানবাহনে  যখন জ্বালানি প্রয়োজন হবে তখন তা আপনি পরিবেশ থেকেই নিতে পারবেন, যা আপনার জ্বালানি খরচ  একেবারে কমিয়ে দিবে।

Source: disruptionhub.com 

২. ইলেক্ট্রনিক্স

বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক্সে সিলিকনের ট্রানজিস্টর ও কন্ডাকটর ব্যবহার করা হয়। যা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রত্যাশিত সার্ভিস দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক্স সার্কিটগুলো যদি গ্রাফিন দিয়ে বানানো হয় তবে সেটি অধিক নমনীয় হবে এবং তা যেকোনো আকারের ডিভাইসে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। সামনের দিনগুলোতে যে ট্রানজিস্টর ব্যবহৃত হবে এবং তার ভেতরে যে কন্ডাকটর থাকবে সেখানে যদি গ্রাফিন ব্যবহার করা হয়, তবে অনেক শক্তিশালী ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি তৈরি করা সম্ভব হবে। কম্পিউটারের প্রসেসরে যদি গ্রাফিন ব্যবহার করা যায়, তবে কম্পিউটার গরম হওয়ার সমস্যা চিরতরে গায়েব হয়ে যাবে। শুধু কম্পিউটারই নয় বরং স্মার্টফোন, টিভি বা যেকোনো ইলেক্ট্রনিক্সে এটি ব্যবহার করে হিটিং সমস্যা সম্পূর্ণ দূর করা সম্ভব।

৩. মরিচামুক্ত পৃথিবী

বর্তমানে মরিচা এক আতংকের নাম। মহামূল্যবান বস্তুর সৌন্দর্য্য নষ্ট করে ফেলে এই মরিচা। এর কবল থেকে বাঁচাতে পারে গ্রাফিন। রঙের সাথে যদি গ্রাফিন মিশিয়ে কোনো কিছু রং করা হয়, তবে তাতে আর কোনো দিনই মরিচা ধরবে না। গবেষকদের মতে, গ্রাফিন শুধু মরিচাই রোধ করবে না বরং যন্ত্রপাতি বা বস্তুকে পানি ও বাতাস ও অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের হাত থেকেও রক্ষা করবে। শিল্প কারখানায় গ্রাফিনের ব্যবহার পৃথিবীর চিত্র পাল্টে দিতে পারে। ঘরের প্রয়োজনীয় বাসন-কোসন ও আসবাবপত্র থেকে শুরু করে গাড়ি ,জাহাজ, দালানকোঠা সবই পাবে মরিচা থেকে সুরক্ষা ।

Source: paintsandcoatingsexpert.com

৪. খেলাধুলার জগত

খেলাধুলার বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির বিখ্যাত ডাচ কোম্পানি হেড ২০১৩ সাল থেকে গ্রাফিন দিয়ে টেনিস খেলার ব্যাট তৈরি করে আসছে। আর এই প্রযুক্তি বাজারে আসার সাথে সাথে সফলতার মুখ দেখতেও শুরু করে দিয়েছে। শুধু টেনিসেই নয়, গ্রাফিনের ভেলকি অন্যান্য খেলাধুলাতেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

Source: today.uic.edu

৫. চিকিৎসা সেবা

ক্যান্সারকে বলা হয় মরণব্যাধি। এই রোগের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ওষুধ ও পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে।  কিন্তু তারপরও অনেক ক্যান্সার আক্রান্তদের অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। এই অকালমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে গ্রাফিন। গ্রাফিন অক্সাইড ক্যান্সার প্রতিরোধের এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্যান্সার ছাড়াও আরও কিছু মারাত্মক রোগের চিকিৎসায় গ্রাফিন ব্যবহার করা যেতে পারে। চিকিৎসাশাস্ত্রে গ্রাফিনের ব্যবহার চিকিৎসা পদ্ধতির দৃশ্যপট পাল্টে দিতে পারে।

৬. বুলেটপ্রুফ বর্ম

গ্রাফিন এতো পাতলা পদার্থ হয়েও কীভাবে বুলেট প্রুফে ব্যবহার হতে পারে তা অকল্পনীয়। কিন্তু গবেষণায় উঠে এসেছে গ্রাফিনে কেভলার রয়েছে যা বুলেট প্রুফ বর্ম তৈরিতে ব্যবহার হয়। গ্রাফিনের ব্যবহার সামরিক ক্ষেত্রের দৃশ্যপটও পরিবর্তন করে ফেলতে পারে।

Source: graphene-info.com

৭. শক্তিশালী ব্যাটারি

ব্যাটারিতে যদি গ্রাফিন ব্যবহার করা হয় তবে ব্যাটারির কার্যকারিতা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এখন মোবাইল ফোনের ব্যাটারি চার্জ করতে কয়েক ঘন্টা সময় লাগে কিন্তু গ্রাফিনের ব্যাটারি চার্জ হবে মাত্র কয়েক মিনিটেই এবং চার্জও দীর্ঘস্থায়ী হবে। শুধু মোবাইল ফোনের ব্যাটারিই নয়, যে কোনো ব্যাটারিতে গ্রাফিন ব্যবহার করে দৈনন্দিন জীবনকে আরও  গতিশীল করে তোলা সম্ভব হবে। গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, গ্রাফিন ব্যাটারি একবার চার্জ করে ৫০০ মাইল পর্যন্ত গাড়ি চালানো সম্ভব।

Source: news.mit.edu

৮. ডিসপ্লে

আজকের দিনে মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, মনিটর গুলোতে ইন্ডিয়াম টিন অক্সাইড ধাতু ব্যবহার করা হয়। ইন্ডিয়াম টিন অক্সাইড অনেক গুণসম্পন্ন একটি ধাতু কিন্তু গ্রাফিনের গুণ এর চেয়েও অনেক বেশি। গ্রাফিনের  তৈরি স্ক্রিন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বাঁকানো সম্ভব হবে। তাছাড়া ফোনের স্ক্রিন যদি গ্রাফিন দিয়ে তৈরি করা হয়, তবে ফোনের স্ক্রিন কখনোই ভাঙবে না।

Source: dailymail.co.uk

৯. থ্রিডি ক্যামেরা সেন্সর

গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ ক্যামেরার চেয়ে গ্রাফিনের ক্যামেরা এক হাজার গুণ বেশি কর্মক্ষম। থ্রিডি ছবি তুলতে গ্রাফিন ক্যামেরা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়াও বর্তমানে নাইট ভিশন ক্যামেরাগুলোতে সিমোস নির্ভর সেন্সর ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেটি যদি গ্রাফিন দিয়ে তৈরি করা যায়, তবে আরো উন্নত নাইট ভিশন ক্যামেরা তৈরি করা সম্ভব হবে। সেন্সর অনেক বেশি তথ্য ধারণ  করতে পারবে এবং অনেক উন্নত ইমেজ তৈরি করবে।

 

Source: www.chemistryviews.org

১০. পানি বিশুদ্ধকরণ

বিশ্বজুড়ে সৃষ্ট বিশুদ্ধ পানি সংকট সমস্যার সমাধান দিতে পারে এই গ্রাফিন। গ্রাফিন প্রায় ৯০% অপটিক্যাল ট্র্যান্সপারেন্ট একটি  ধাতু। যেহেতু এটি বন্ধনের পাতলা আবরণে তৈরি, তাই এটির গঠনে অনেক ছিদ্র রয়েছে।  একারণে এটি বেশ ভালো ওয়াটার ফিল্টার হিসেবে কাজ করতে পারে।

Source: hackaday.com

একটি ওয়াটার ফিল্টারে যদি গ্রাফিন থাকে তবে গ্রাফিনের লোমকুপ বা ছিদ্র দিয়ে শুধু বিশুদ্ধ পানিই বের হবে এবং পানির সাথে দ্রবীভূত লবণ বা অন্য যেকোনো কিছু আটকে যাবে।  সমুদ্রের পানি পরিশোধন বা কোন গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশে পানি পরিশোধনের ক্ষেত্রে  গ্রাফিনের ওয়াটার ফিল্টার সর্বোচ্চ পানি বিশুদ্ধিকরণের কাজ করবে।

Source: scitechdaily.com

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যদি এভাবে গ্রাফিনের ব্যবহার শুরু করা সম্ভব হয়, তবে পৃথিবীকে আমরা এক নতুন রূপে দেখতে পাবো। অনেক অকল্পনীয় বিষয়কে বাস্তব রূপ দান করতে পারবে এই গ্রাফিন। আর অবাক পৃথিবী দেখবে গ্রাফিনের চমক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *