মিশন যখন সূর্য জয়

ছবিসূত্রঃ expressnews.com

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বিস্মিত হতো আকাশ দেখে, আকাশের অগনিত তারা দেখে। মানুষ বিস্মিত হত দিনের বেলার সূর্যের তপ্ত আলো আর রাতের বেলা চাঁদের স্নিগ্ধ আলো দেখে। এমনকি প্রাচীনকালে মানুষ তারা দেখে দেখে তাদের যাত্রা, অভিযানের দিক নির্দেশনা ঠিক রাখত। এই তারাদের মধ্যে সব চেয়ে উজ্জ্বল এবং আকারে বড় দুটি তারা হলো চাঁদ এবং সূর্য।

চাঁদ এবং সূর্যকে তারা বললে একটু কেমন যেন মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক না। কারন আমাদের কাছে তারা মানে খালি চোখে আকাশে মিটি মিটি করে জ্বলা কিছু গ্রহ। আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্র হলো সূর্য। আর আমাদের পৃথিবী, সূর্য থেকে যতটা না কাছে তার থেকে বেশি কাছে হল চাঁদ। আর এই কারনেই চাঁদ এবং সূর্য আমাদের বিমোহিত করে আসছে আদিকাল থেকে। আমাদের ভেতরে জাগিয়েছে জানার অদম্য ইচ্ছা ও কৌতূহল।

সেই অদম্য ইচ্ছা আর কৌতূহল থেকেই মানুষ প্রথম চাঁদে পা রাখে ১৬ জুলাই ১৯৬৯ সালে। এবং সেই থেকেই শুরু হয় মানুষের চন্দ্রাভিযানের জয়যাত্রা। চাঁদকে জয় করার পর স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মাথায় চেপে বসে সূর্য জয়ের ইচ্ছা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়ত সম্ভব না। মানুষের চাঁদে পা রাখার আগে ১৯৫o সালে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি আফ সিকাগোর অধ্যাপক ইউজিন পার্কার সূর্যের বাতাস বর্ণনা করেন। সূর্য থেকে অবিরত নির্গত হওয়া দ্রুত গতি সম্পন্ন কণা ও চৌম্বকত্বকে এক কথায় সূর্যের বাতাস বলা হয়। তখন তিনি হয়ত নিজেও জানতেন না সূর্যের বাতাস বিষয়ক তার সেই বর্ননাই একদিন বাস্তবেই আমাদেরকে সূর্যের খুব কাছে নিয়ে যাবে। আর যে মহাকাশযানটি এই অবাস্তবকে বাস্তবে রুপান্তর করেছে তার নাম হল “পার্কার সোলার প্রব” যা উৎক্ষেপিত হয় ১২ আগষ্ট ২০১৮ তারিখে আমেরিকার কেপ ক্যনাভেরাল এয়ারফোর্স ষ্টেশন, ফ্লোরিডা থেকে।

ছবিসুত্র : .nbcnews.com

যুগের পর যুগের বৈজ্ঞানিক চিন্তা এবং গবেষনার পর পার্কার সোলার প্রব তৈরির প্রথম ঘোষনা দেয়া হয় ২০০৯ সালে যা প্রথম প্রস্তাবিত হয় ১৯৫৮ সালে। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১.৫ বিলিয়ন ডলার। পার্কার সোলার প্রবের নকশা তৈরি ও নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে আমেরিকার জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ফলিত পদার্থবিদ্যার ল্যাবরেটরি। নির্মাণের নির্দেশনায় ছিলেন ব্রিটিশ বংশভুত মহাকাশবিজ্ঞানী ডক্টর নিকি ফক্স। পার্কার সোলার প্রবের নামকরণ করা হয় জীবিত কোনো ব্যাক্তির নামে, যা মহাকাশে যাত্রার ইতিহাসে প্রথম। এবং সেই ব্যক্তি হলেন সূর্যের বাতাস বর্ণনাকারি ইউজিন পার্কার।

ছবিসূত্র: gossipier.com

পার্কার সোলার প্রবের নকশা করা হয় ১৯৯০ সালে নাসার একটি প্রকল্প “সোলার অরবিটার” এর আদলে। পার্কার সোলার প্রব সূর্যের বায়ুমণ্ডলে ২৪ বার প্রদক্ষিন করবে  ৭ বছর ধরে, ৬ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে থেকে। এই দূরত্ব অনেকের কাছে অনেক বেশি মনে হলেও ডক্টর নিকি ফক্সের কাছে তা বেশি নয়। তার মতে আনুমানিকভাবে যদি সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব যদি ১ মিটার হয়, তবে সূর্য থেকে পার্কার সোলার প্রবের দূরত্ব হবে মাত্র ৪ সেন্টিমিটার।

ছবিসূত্র: baltimoresun.com

পার্কার সোলার প্রব যখন সূর্যকে প্রদক্ষিন করবে তখন সূর্যের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা থাকবে ১৩৭৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই উচ্চ তাপমাত্রা থেকে সোলার প্রবের ভেতরের যন্ত্রাংশ রক্ষার জন্য এর দেয়াল ৪.৫ ইঞ্চি পুরু কার্বন যৌগ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে যাতে সোলার প্রবের ভেতরের তাপমাত্রা কক্ষতাপমাত্রায় থাকে।

ছবিসূত্র: releases.jhu.edu

সোলার প্রব উৎক্ষেপণের পরে নির্ধারিত ধাপসমূহ সম্পূর্ণ করে ছয় সপ্তাহ পর ২৮ সেপ্টেম্বর সূর্যের দ্বিতীয় নিকটতম গ্রহ ভেনাসের কাছাকাছি পৌঁছাবে। এরপরে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাকি ধাপগুলো সম্পন্ন করে সূর্যের নিকটতম গ্রহ মার্কারির কক্ষপথ অতিক্রম করে ১ নভেম্বর, সূর্যের করনাতে প্রথমবার প্রদক্ষিন শুরু করবে। এভাবে প্রদক্ষিণ আরও ২৩ বার।

ছবিসূত্র : parkersolarprobe.jhuapl.edu

প্রাথমিকভাবে পার্কার সোলার প্রব উৎক্ষেপণের যে সব উদ্দেশ্য আছে তার মধ্যে প্রথম এবং প্রধান হলো সৌর পদার্থবিদ্যার অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা, যা গত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলছে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলে তারা হয়ত জানতে পারবে কেন সুর্যের বায়ুমণ্ডলে যে বিভিন্ন গ্যসের আচ্ছাদন, যা করনা নামে পরিচিত তার তাপমাত্রা সূর্য পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়েও বেশি। তারা আরও জানতে পারবে যদি সূর্যের বাতাসে যদি কোনো প্রকার অসামাঞ্জস্যতা দেখা দেয় তা কীভাবে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটাবে, মহাকাশের আবহাওয়ায় পরিবর্তন আনবে এবং পূর্ব উৎক্ষেপিত উপগ্রহগুলোর উপর কী প্রভাব ফেলবে। এছাড়াও পার্কার সোলার প্রব উৎক্ষেপণের যে উদ্দেশ্যগুলো আছে তা নিম্নরূপ :

১. সূর্য করনা এবং সূর্য বাতাসে যে শক্তি  সূর্য করনা এবং সূর্য বাতাসকে উত্তপ্ত ও গতিদান করে তার উৎস খুঁজে বের করা।

২. সূর্য করনাতে এবং সূর্য বাতাসে যে গ্যাসীয় আচ্ছাদন ও চৌম্বক ক্ষেত্র আছে তার কাঠামো এবং গতিসংক্রান্ত তথ্য খুঁজে বের করা।

৩. যে শক্তি বিভিন্ন সূর্য নিঃসরিত শক্তি কনাকে উত্তপ্ত করে ও তরান্বিত করে তার উৎস আবিষ্কার করা।

১৯৫০ সালে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ও আমেরিকার ইউনিভার্সিটি আফ সিকাগোর অধ্যাপক ইউজিন পার্কার প্রথম বেশ কিছু ধারনা দেন সূর্য সহ আকাশের অগনিত তারা কীভাবে শক্তি নিঃসরণ করে। তিনি তখন করনাতে গ্যাসীয় আচ্ছাদন, চৌম্বক ক্ষেত্র, চৌম্বক কণা এই পুরো জটিল বিষয়গুলো বর্ননা করেন যার ফলস্বরূপ ১৯৫৮ সালে মানুষ প্রথম ভাবে সূর্য জয়ের কথা, সূর্যের রহস্য উদ্ঘাটনের কথা। কিন্তু তখন তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি কারন, তখন পৃথিবী প্রযুক্তিগত দিক থেকে যথেষ্ট অগ্রসর ছিল না। তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ৬০ বছর। আর এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার ফসল হলো সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির মহাকাশযান পার্কার সোলার প্রব, যার মহাকাশযাত্রা যদি সফল হয় তবে তা হবে মহাকাশ বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারি সাফল্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *