একটি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের মূলে রয়েছে মানব সম্পদ। এই মানব সম্পদ সঠিক পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করতে না পারলে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব না। তাই মানবশক্তিকে বলা হয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার জীবন। আবার এই মানব সম্পদকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যায় কর্মী নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সুতরাং প্রাতিষ্ঠানিক সফলতার অনেকটাই নির্ভর করে দক্ষ মানব সম্পদের উপর।

কর্মী নির্বাচন এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে সম্ভাবনাময় সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মীকে খুঁজে বের করে তাদেরকে প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করতে উৎসাহিত করা হয় এবং আবেদনকৃত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে যাচাই করে নির্বাচন করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি ৯টি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পরিচালিত হয়। ধাপগুলো হলো:

১. নির্বাচন প্রক্রিয়া

কর্মী নির্বাচন প্রক্রিয়া; Source: Toppr

প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কর্মীর প্রয়োজন পড়ে। যার ফলে তারা তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম অনুযায়ী কর্মী নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে। কিন্তু ব্যবস্থাপনার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া অনুযায়ী কর্মী নির্বাচনের প্রধান পদক্ষেপ তথা ধাপগুলো একই রকম থাকে৷ সুতরাং, কর্মী নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাপনাগত নিয়ম এবং ধাপ মেনে কর্মী নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। যেটা সাধারণত প্রতিষ্ঠানের মূল পরিকল্পনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

২. প্রাথমিক সাক্ষাৎকার

প্রাথমিক সাক্ষাৎকার বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যেখানে সম্ভাবনাময় কর্মীদের খুঁজে বের করে তাদেরকে চাকরির জন্য আবেদন করতে অনুপ্রাণিত করা হয়। পাশাপাশি এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কর্মীদের একাডেমিক রেজাল্ট অথবা অভিজ্ঞতার কথা বিবেচনা করে আবেদনের একটি সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা বা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

এটি কর্মীসংস্থানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এই পর্যায়ে কর্মীরা তাদের কাজের ধরণ ও সম্মানী সম্পর্কে ধারণা পায়। যার ফলে তারা অনুপ্রাণিত হয় এবং চাকরির জন্য দরখাস্ত করে। সুতরাং প্রয়োজনীয় সংখ্যক যোগ্য কর্মী নির্বাচনের জন্য কাম্য সংখ্যক নিয়োগ প্রত্যাশী উপযুক্ত কর্মীকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার আওতায় আনার জন্য এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।

৩. সিভি প্রাপ্তি

এই পর্যায়ে সম্ভাব্য কর্মীবৃন্দ প্রতিষ্ঠানে সিভি পাঠানোর মাধ্যমে কাজের জন্য আবেদন করে। এই সিভিতে তারা তাদের প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত তথ্য, কাজের অভিজ্ঞতা, শখ এবং স্বার্থ সম্পর্কে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। সিভির সাথে চাকরির সম্ভাবনা অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। কেননা সিভি দেখেই ব্যবস্থাপক প্রার্থী সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা নেন।

কর্মীর সিভি প্রাপ্তি; Source: seek.co.nz

যেমন সিভি যদি নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে গিয়ে লেখা হয়, সিভি যদি সাজানো গোছানো না হয় অথবা একাডেমিক যোগ্যতা ছাড়া যদি প্রার্থীর কোনরকম অভিজ্ঞতা না থাকে, সেক্ষেত্রে সেই কর্মী কম গুরুত্ব পাবে। ঠিক তেমনি যার এ ধরনের কোনো অতিরিক্ত অভিজ্ঞতা আছে সে বেশি গুরুত্ব পাবে। সুতরাং সিভি লেখার সময় অবশ্যই নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে লিখা প্রয়োজন এবং প্রয়োজনীয় তথ্য ও অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা প্রয়োজন।

৪. স্ক্রিনিং অ্যাপ্লিকেশন

চাকরির জন্য যোগ্য প্রার্থীদের থেকে আবেদন গ্রহণ করার পর সেগুলো একটি বিশেষ স্ক্রিনিং কমিটি দ্বারা প্রদর্শিত হয়। এই বিশেষ স্ক্রিনিং কমিটি মূল সাক্ষাৎকারের জন্য সিভি দেখে যোগ্যতা বিবেচনা করে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচন করে। এক্ষেত্রে আবেদনকারীদের একাডেমিক ফলাফল, কাজের অভিজ্ঞতা, সিভি লিখার ধরণ ইত্যাদি বিশেষ মানদণ্ডে বিবেচনা করা যেতে পারে।

৫. কর্মী নিয়োগ পরীক্ষা

একাডেমিক ফলাফল তো অনেক দেখা হলো, এবার আসা যাক মূল চাকরির পরীক্ষায়। এমন অনেকেই আছে যাদের একাডেমিক রেজাল্ট খুব ভালো থাকার সত্ত্বেও সাধারণ জ্ঞান, উপস্থিত বুদ্ধি অথবা প্রায়োগিক দক্ষতা খুবই কম। কিন্তু একটি ভালো প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারীর হওয়া দরকার বুদ্ধিমান, চালাক-চতুর এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা কাজে লাগানোর মতো ক্ষমতাসম্পন্ন।

চাকরির লিখিত পরীক্ষা; Source: Federal Jobs

তাই কোনো সংস্থা তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের উপযুক্ত কাজে নিয়োগ দেওয়ার আগে তাদের প্রতিভা ও দক্ষতাগুলোর জন্য একটি পরীক্ষা নেয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই পরীক্ষাটি বিভিন্নভাবে নেওয়া হয়৷ যেমন বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা, স্বাভাবিক দক্ষতা পরীক্ষা, ব্যক্তিত্ব পরীক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়।

৬. কর্মী সাক্ষাৎকার

কর্মীর সাক্ষাৎকার; Source: Aberdeen

কর্মী নিয়োগ পরীক্ষার পরবর্তী ধাপ হলো কর্মী সাক্ষাৎকার। মূলত প্রার্থীর ওরাল কমিউনিকেশন দক্ষতা এবং বিস্তারিতভাবে সংস্থায় কাজ করার ক্ষমতা সনাক্ত করার জন্য কর্মী সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। একটি কর্মী সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য প্রার্থীর উপযুক্ততা খুঁজে বের করা, তার জন্য নির্ধারিত কাজ সম্পর্কে ধারণা কেমন এবং সম্ভাব্য কর্মীর কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করা যায় তা জানা। সঠিক চাকরির জন্য সঠিক ব্যক্তিদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি কর্মীসংস্থান সাক্ষাৎকার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং সমালোচনামূলক।

৭. রেফারেন্স চেক করা

একজন সম্ভাব্য কর্মচারী নির্বাচনে রেফারেন্স প্রদানকারী ব্যক্তির তথ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস। একটি রেফারেন্স প্রার্থীর ক্ষমতা, পূর্ববর্তী সংস্থাগুলো থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা, নেতৃত্ব এবং পরিচালনার দক্ষতা সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করতে পারে। যেমন কোনো প্রার্থী যদি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় চাকরির আবেদন করে, সেক্ষেত্রে প্রার্থী চাকরি থাকা সত্ত্বেও কেন আবেদন করেছে সে সম্পর্কে জানতে হবে৷ কিন্তু এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী কর্মরত প্রতিষ্ঠানের মালিক যদি তার সম্পর্কে ভালো মন্তব্য করে তাহলে তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। অর্থাৎ রেফারেন্স দাতা কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য চাকরির ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানব সম্পদ বিভাগের সাথে গোপন রাখা হয়।

৮. মেডিকেল পরীক্ষা

প্রতিষ্ঠানের কর্মী নির্বাচন প্রক্রিয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হলো মেডিকেল পরীক্ষা। মেডিকেল পরীক্ষার মাধ্যমে কর্মীনিয়োগ কমিটি তাদের সম্ভাব্য কর্মীদের চাকরিতে দায়িত্ব পালন করার মতো শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা আছে কিনা সে সম্পর্কে ধারণা নেন।

মেডিকেল চেকআপগুলোর একটি ভালো সিস্টেম নিশ্চিত করে যে, কোন স্বাস্থ্যের কর্মচারীর মান বেশি এবং কার দ্বারা কী ধরণের কাজ করানো সম্ভব হবে। আবার যেসব কর্মীরা মেডিকেল চেকআপে উক্তীর্ণ হয় না, অর্থাৎ যাদের বিশেষ কোনো শারীরিক সমস্যা থাকে তাদের কর্মীনিয়োগ কমিটি কতৃক বাদ দেওয়া হয়।

৯. চূড়ান্ত নির্বাচন এবং নিয়োগ

চুড়ান্ত নির্বাচন ও নিয়োগ; Source: POD HR and Training

এটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পদক্ষেপ। প্রার্থী সফলভাবে সব লিখিত পরীক্ষা, ইন্টারভিউ এবং মেডিকেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর, কর্মীকে ই-মেইল অথবা এপোয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠানো হয়। এপোয়েন্টমেন্ট লেটারে কর্ম দিবস, কর্ম ঘন্টা, বেতন, ছুটির ভাতা, চাকরিতে যোগ দেওয়ার তারিখসহ ইত্যাদি কাজের সমস্ত বিবরণ উল্লেখ করা থাকে। বেশিরভাগ কোম্পানিতে কর্মীদের প্রথমে একটি শর্তাধীন বেতন প্রদান করা হয়৷ পরবর্তীতে কর্মচারীর কর্মক্ষমতার উপর ভিত্তি করে স্থায়ীভাবে বেতন নির্ধারণ করা হয়।

Featured Image Source: VideoBlocks