হেনরি ফোর্ড: অটোমোবাইলের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন যিনি

অটোমোবাইল উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো সর্বপ্রথম শিল্পপতি হলেন হেনরি ফোর্ড। মহান এই ব্যক্তিকে নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।

হেনরি ফোর্ড কে ছিলেন?

১৮৬৩ সালের ৩০ জুলাই হেনরি ফোর্ড যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেইরবার্নের কাছে ওয়েন প্রদেশে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আমেরিকান অটোমোবাইল নির্মাতা যিনি ১৯০৮ সালে ফোর্ড মডেল টি (T) কার তৈরি করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম অটোমোবাইল জগতে অ্যাসেম্বলি লাইন পদ্ধতি নিয়ে আসেন। অ্যাসেম্বলি লাইন হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট একটি কাজের জন্য নির্দিষ্ট শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এভাবে নির্দিষ্ট করে কাজ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় কোনো কাজ সম্পূর্ণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। এই কাজটি বর্তমানে রোবট দিয়ে পরিচালনা করা হয় বড় বড় কোম্পানিগুলোতে। টি দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে পণ্য উৎপাদনের অসাধারণ একটি পদ্ধতি।

Photo Credit: images.google.com

তখন এই পদ্ধতি অটোমোবাইল জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়। এজন্যই মিলিয়ন মিলিয়ন গাড়ি বিক্রির মাধ্যমে কোম্পানিটি বিশ্ববিখ্যাত অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। কালপরিক্রমায় কোম্পানিটি তার বাজারের প্রভাব হারালেও অন্যান্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মার্কিন অবকাঠামোর উপর একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। হেনরি ফোর্ড আমেরিকার অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার কৃতিত্ব অর্জন করার পাশাপাশি নিজেকে পরিচিত করেছেন আমেরিকার নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী হিসেবে।

মডেল টি

বেশিরভাগ আমেরিকানদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের কথা চিন্তা করে ফোর্ড কোম্পানি ১৯০৮ সালে মডেল টি বের করার সিন্ধান্ত নেয় এবং ১৯২৭ সাল পর্যন্ত এই মডেলটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়াও ‘টিন লিজি’ নামে পরিচিত এই গাড়িটি স্থায়িত্ব, বহুমুখিতা এবং দ্রুতগতির কারণে অনেক বড় বাণিজ্যিক সফলতা নিয়ে আসে। শতভাগ সাফল্য নিশ্চিত করার ফলে ১৯১৮ সালের দিকে আমেরিকার মোট গাড়ির প্রায় অর্ধেক গাড়ি ছিল এই মডেলের।

Photo Credit: images.google.com

হেনরি ফোর্ড এবং অ্যাসেম্বলি লাইন

হেনরি ফোর্ড ১৯১৩ সালে তার নিজস্ব কোম্পানিতে অ্যাসেম্বলি লাইন পদ্ধতি ব্যবহার করা শুরু করেন। নতুন এই কৌশলটি ব্যবহারের ফলে একটি গাড়ি তৈরি করতে সময় লাগতো প্রায় ১২ ঘন্টা, সময় কম লাগার পাশাপাশি গাড়ি প্রতি খরচ অনেক কমে আসে। যেমন ১৯০৮ সালে যেখানে মডেল টি’র একটি গাড়ি বানাতে খরচ হতো ৮৫০ ডলার সেখানে অ্যাসেম্বলি লাইন পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে ১৯২৭ সালের দিকে খরচ দাড়ায় মাত্র ৩১০ ডলার।

Photo Credit: images.google.com

বিশ্বস্ত দক্ষ শ্রমিকদের অনুপ্রাণিত করার জন্য ফোর্ড কর্তৃপক্ষ ১৯১৪ সালে অভিনব এক সিস্টেম চালু করেন যেমন প্রতি ৮ ঘন্টা কাজের পর শ্রমিক প্রতি ৫ ডলার মজুরী দেওয়া হতো যা ছিল পূর্বের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এক্ষেত্রে ফোর্ডের ব্যবসায়ী গুণের প্রশংসা না করলেই নয় কারণ তৎকালীন শ্রমিকদের এত মজুরী দিয়েও সাশ্রয়ী মূল্যে গাড়ি বের করা ছিল সত্যই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রাথমিক জীবন এবং শিক্ষা

হেনরি ফোর্ড যখন ১৩ বছর বয়সী ছিলেন, তখন তার বাবা তাকে একটি পকেট ঘড়ি উপহার দেন কিন্তু কোনো কারণে ঘড়িটি নষ্ট হলে কৌতূহলী ফোর্ড নেমে পড়েন পকেট ঘড়িটি ঠিক করার প্রচেষ্টায়, অবশেষে তিনি তার প্রিয় ঘড়িটি ঠিক করে ফেলেন কোনো ঝামেলা ছাড়াই। এরপর থেকেই তার বন্ধু এবং প্রতিবেশিরা অভিভূত হয়ে তাদের নষ্ট ঘড়িগুলো ঠিক করার জন্য নিয়ে আসতেন ফোর্ডের কাছে।

Photo Credit: images.google.com

কৃষক পরিবারে জন্ম হলেও কৃষিকাজ ভালো না লাগার ফলে ‍১৬ বছর বয়সে ফোর্ড বাড়ি ছেড়ে একটি জাহাজ নির্মাণ কোম্পানিতে মেকানিস্টের চাকরি নেন। পরের বছরগুলোতে, তিনি মনোযোগের সাথে বাষ্প ইঞ্জিন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। ১৮৮৮ সালে ফোর্ড ক্লারা আলা ব্রায়ান্টকে বিয়ে করেন এবং ১৮৯৩ সালে এই দম্পতির প্রথম পুত্র সন্তান এডেল জন্মলাভ করে।

হেনরি ফোর্ড এবং টমাস এডিসন

১৮৯০ সালে হেনরি ফোর্ডকে ডেট্রয়েট এডিসন কোম্পানির একজন প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং একই বছর তার প্রতিভা তাকে প্রধান প্রকৌশলী পদে উন্নীত করে। ১৮৯২ সালে ফোর্ড প্রথম পেট্রোলচালিত ইঞ্জিন নির্মাণ করেছিলেন, যার দুইটি সিলিন্ডার এবং ৪ হর্সপাওয়ার ইঞ্জিন ছিল। ১৮৯৬ সালে তিনি প্রথম কোয়াড্রিসাইকেল মডলের প্রথম গাড়ি নির্মাণ করেন।

Photo Credit: images.google.com

একই বছরে ফোর্ড এডিসন কর্তৃপক্ষের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যোগ দেন এবং তারা অটোমোবাইল পরিকল্পনার কথা শেয়ার করেন। টমাস এডিসন অভিভূত হয়ে তাকে উৎসাহিত করেন দ্বিতীয় বারের মতো আরও ভালো একটি মডেল নির্মাণের জন্য। ১৮৯৯ সালের দিকে ফোর্ড এডিসনের কোম্পানি ছেড়ে দিয়ে তার নিজস্ব কোম্পানির উন্নয়নে লেগে পড়েন।

ফোর্ড মোটর কোম্পানির যাত্রা

হেনরি ফোর্ড ১৯০৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফোর্ড মোটর কোম্পনির প্রতিষ্ঠা করেন।

দর্শন এবং দেশপ্রেম

হেনরি ফোর্ড শান্তুিবাদী মতবাদের ছিলেন। এজন্য তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিরোধিতা করেছিলেন, এমনকি ইউরোপে একটি শান্তি জাহাজকে অর্থায়নও করেছিলেন। পরবর্তিতে ফোর্ড পরিবার গবেষণা, শিক্ষা ও উন্নয়ন জন্য ফোর্ড ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন।

Photo Credit: images.google.com

ফোর্ড কর্মচারীদের দিকটি বিবেচনা করে তার কোম্পানির মুনাফা ভাগ করে দিতেন।  যেসব গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারী ৬ মাসের অধিক সময় ধরে কোম্পানির সাথে থাকতো ফোর্ড এসব কর্মচারীর সম্মানজনক জীবন পরিচালনার জন্য কোম্পানির মুনাফা ভাগাভাগা করে দিতেন। যাতে তার কর্মচারীরা স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে পারে এবং কোনো প্রকার অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকে।

পুরষ্কার

হেনরি ফোর্ড মানবপ্রেমিক থাকা সত্ত্বেও, তিনি একজন বিরোধী ইহুদি ছিলেন। ১৯২১ সালে ইহুদি বিরোধী কিছু লেখা প্রকাশ করার মধ্যমে তিনি দ্য ডুরবর্ন ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকাকে সমর্থন করেন। মজার বিষয় তিনি নিজেই একজন ইহুদি হয়ে মনে করতেন “ইহুদিরা বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমস্যা”। এতকিছুর পরও ফোর্ডকে জার্মান ঈগলের গ্র্যান্ড ক্রস প্রদান করা হয় এবং ১৯৩৮ সালে তিনি অ্যাডলফ হিটলার কর্তৃক নাজিস (Nazis) পুরষ্কারে ভূষিত হন।

Photo Credit: images.google.com

মৃত্যু

সবাইকে কাঁদিয়ে হেনরি ফোর্ড ১৯৪৭ সালের ৭ এপ্রিল সেরিব্রাল হ্যামারেজে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *