যেভাবে কর্মক্ষেত্রে অন্তর্মুখী কর্মীরা সফল হন

photo: introvert spring

আমাদের সমাজে দুই শ্রেণীর মানুষ আছে; অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী। বহির্মুখীরা যখন নিজের ঢোল নিজেই পেটাতে ব্যস্ত থাকেন, অন্তর্মুখীরা তখন নীরবে নিজের কাজ করে যান। বহির্মুখীরা নিজেকে বাইরে প্রকাশ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, আর অন্তর্মুখীরা নিজের সাথে কথোপকথন করতে বেশি ভালবাসেন।সঙ্গত কারণেই বহির্মুখীদের চেয়ে অন্তর্মুখীরা কর্মক্ষেত্রে অধিক সফল হন। বহির্মুখীরা কোনো কিছু না ভেবেই মতামত দিয়ে থাকেন, কিন্তু অন্তর্মুখীরা মতামত দেওয়ার আগে ভালো করে ভেবে নেন। তাই তাদের কথা ও কাজে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

photo: introvert spring

আমি ইতিপূর্বে একটি নিবন্ধ অন্তর্মুখীদের কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে অন্তর্মুখী ও বহির্মুখীদের কয়েকটি বিশেষ পার্থক্য তুলে ধরব, যা আপনার কাছে স্পষ্ট করে তুলবে অন্তর্মুখীরা কেন কর্মক্ষেত্রে বেশি সফল হয়।

১. তারা সাধারণত অন্যদের মধ্যে নেতিবাচক আবেগের জন্ম দেন না

গবেষণায় দেখা গেছে, বৃহৎ পরিসরে  চিন্তা করলে বহির্মুখীরা অন্তর্মুখীদের চেয়ে দৃশ্যত অনেক বেশি ইতিবাচক আবেগ সম্পন্ন হয়ে থাকেন। কিন্তু এর বিপরীতে বহির্মুখীরা সব সময় মানুষকে ইতিবাচক অনুপ্রেরণা দিতে পারে না।

photo: medium

এমনকি গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বহির্মুখীরা দলগত কাজে কর্মীদের সাথে জটিল সম্পর্ক তৈরি করে ফেলে। নিজের বেশি প্রকাশ প্রবণতার কারণে তারা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। তাদের দ্বারা দলের মধ্যে বেশি নেতিবাচক আবেগ ছড়ানোর ঘটনাও ঘটে। বহির্মুখীরা মানুষের মধ্যে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে তারা তাদের অবস্থান হারিয়ে ফেলে।

পক্ষান্তরে একজন অন্তর্মুখী মানুষ সবসময় ইতিবাচক থাকেন এবং নীরবে মানুষের মধ্যে ইতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়ে চলেন। তারা সবার কাছে সম্মানিত হন এবং প্রত্যেকটি কথার জন্য সবার চোখে গ্রহণযোগ্য অবস্থানে থাকেন।

২. প্রয়োজনে তারা বহির্মুখীদের মতো নেটওয়ার্কিং করতে জানেন

অন্তর্মুখী মানুষদের ব্যাপারে সবার মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, তারা কখনো বহির্মুখীদের মতো সামাজিক হতে পারেন না। কিন্তু এই ধারণা ভুল। অনেক অন্তর্মুখী মানুষ আছে যারা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সামাজিক। তারা সবসময় নীরব থাকেন তার অর্থ এই নয় যে প্রয়োজনে সরব হতে জানেন না।

photo: morgan consulting

দূর থেকে লাজুক প্রকৃতির মনে হলেও প্রয়োজনে তারা বহির্মুখীদের চেয়েও বেশি সরব হতে পারে এবং চমৎকার নেটওয়ার্কিং করতে জানে। লেখক সুসান কাইন ২০১২ সালে ‘দি পাওয়ার অফ ইন্ট্রোভার্টস’ শিরোনামের TED বক্তৃতায় বলেছিলেন, লাজুকতা হল সামাজিক মূল্যায়নের ভয়। আর অন্তর্মুখিতা হল সামাজিক উদ্দীপনায় আপনার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত বিষয়।

অনেক বহির্মুখী মানুষ আছে যারা দ্বিধাগ্রস্ত এবং নতুন মানুষের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে খুবই আনাড়ী। অথচ এমন অনেক অন্তর্মুখী মানুষ আছেন যারা খুবই সামাজিক এবং নতুন কারো সাথে যোগাযোগে খুবই পারদর্শী। আসলে সার্বক্ষণিক বাচালতা অথবা নীরবতা দিয়ে অন্তর্মুখীদের সাফল্য-ব্যর্থতা মূল্যায়ন করা যায় না। তারা যেমন নীরব থাকেন তেমন প্রয়োজনে বহির্মুখীদের চেয়েও সরব হয়ে উঠতে জানেন।

৩. তাদের আগ্রহের বিষয়ে তারা কখনো নীরব থাকেন না

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রের বহির্মূখীরা খুবই চমকপ্রদ হয়ে থাকে এবং প্রতিষ্ঠানের যেকো্নো বিষয়ে তারা আগে কথা বলেন। পক্ষান্তরে অন্তর্মুখীরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না, সব বিষয়ে নীরব থাকে। এই ধারণাটিও অমূলক। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্তর্মুখীরা নীরব থাকে সত্য, কিন্তু প্রয়োজনের সময় তারা কথা বলতে পিছপা হন না, বিশেষ করে তাদের আগ্রহের বিষয়ে তারা গঠনমূলক কথা বলে থাকেন। সাধারণত যে বিষয়ে তাদের আগ্রহ কম তা নিয়ে তারা মাথা ঘামান না।

photo: commisceo-global

দীর্ঘ সময় থিয়েটার মঞ্চে কাটানো অন্তর্মুখী ঘরানার লেখক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল বলেন, ‘কথা বলা বহির্মুখীদের কোনো বিশেষ কাজের মধ্যে পড়ে না। বহির্মুখীতার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা অনেক প্রসিদ্ধ অভিনেতা আছে যারা অন্তর্মুখী স্বভাবের।’ জেনিফার বি কানওয়ালার নামে অপর এক লেখক বলেন, বহির্মুখীরা তাৎক্ষণিক মঞ্চে সফল হন, ভবিষ্যতের জন্য নয়।

৪. তারা অন্ধভাবে কিছু করেন না

অন্তর্মুখীদের একটি চমৎকার স্বভাব আছে। তাদের চরিত্রে প্রতিফলন এবং সাবধানতা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। তারা কখনোই অন্ধভাবে বা বেপরোয়াভাবে কাজ করেন না। কোনো কিছু করার আগে তারা নিশ্চিত হয়ে নেন, চরিত্রগতভাবে যা তাদের অবিচল করে তোলে। সুতরাং দ্বিধা এবং ভুল দূর করতে অন্তর্মুখীদের যেকোনো অবস্থা বুঝতে যথেষ্ট সময় দিন। দীর্ঘমেয়াদে ভাল ফল পেতে যেকোনো বিষয় বিশ্লেষণ করতে তাদের সময় দিতেই হবে।

photo: entrepreneur

অন্যদিকে বহির্মুখীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে খুব দ্রুত যেকোনো ঘটনায় বা কথায় প্রতিক্রিয়া দিয়ে থাকে। তারা খুব দ্রুত প্রয়োজনীয় হিসাব-নিকাশ করে আপনাকে মতামত দিতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এটা খুব ভালো গুণ। কেননা স্বতঃস্ফূর্ততা কোনো মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে। তবে এমন স্বতঃস্ফূর্ত দ্রুত প্রতিক্রিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপদজনক। কেননা এতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

৫. তারা পৃষ্ঠপোষক অফিস রাজনীতি পছন্দ করেন না

সব অফিসেই কিছু অগভীর চিন্তার মানুষ থাকে, যারা সবকিছুর মধ্যেই দোষ খুঁজে বেড়ায় এবং সারাক্ষণ একে অপরের সাথে অপ্রয়োজনীয় সমালোচনায় মত্ত থাকে। এই স্বভাবের ব্যক্তিরা কর্মক্ষেত্রের সবকিছু নিয়ে রাজনীতি করতে পছন্দ করে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বা অজ্ঞাতসারে সব জিনিসকে হালকাভাবে গ্রহণ করে। আপনি যদি এইসব ব্যক্তির ব্যাপারে সচেতন না হন, তবে অচিরেই তাদের দ্বারা আক্রান্ত হবেন এবং অকারণ সমালোচনা ও রাজনীতির শিকার হবেন।

photo: lead economics

এক্ষেত্রে আপনার সহকর্মী যদি একজন অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ হন তাহলে আপনি তার কাছে সবচেয়ে নিরাপদ থাকবেন। অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষরা যেহেতু অকারণ খোশগল্প এবং অপ্রয়োজনীয় ছোট ছোট বিষয়ে আলাপ করতে অপছন্দ করে তাই তারা অকারণে কারো সমালোচনা থেকে দূরে থাকেন। অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষেরা অন্যের ছোট ছোট ভুল ত্রুটি আমলে নেন না এবং সব সময় গভীর ব্যবসায়িক বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট আলোচনায় তারা আগ্রহী হয়ে থাকেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *