পেশা মানুষের জীবন পরিচালনার প্রধান চাবিকাঠি। তাই মানুষ অনেক ভেবে চিন্তে পেশা নির্বাচন করে। তারপর নির্বাচিত পেশার চাকরি খুঁজতে শুরু করে। যখন মানুষ নিজের কাঙ্ক্ষিত চাকরি পেয়ে যায় তখন থেকে তার সব সমস্যার সমাধান হতে শুরু করে। বলার অপেক্ষা রাখে না জীবনের সব রকম সুখ-স্বাচ্ছন্দ ধীরে ধীরে ধরা দিতে শুরু করে।
আপনার বর্তমান পেশা যদি আপনাকে সুখী করে থাকে তবে নিশ্চয়ই এই পেশাটি আপনার চোখে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পেশা। বাস্তবে না হলেও অন্তত আপনার কাছে তাই মনে হয়। কিন্তু পছন্দের পেশাও কখনো কখনো বিরক্তিকর হয়ে যায়। দিন গড়ানোর সাথে সাথে কাজের চাপ বাড়তে থাকে এবং এক সময় অতিরিক্ত কাজের চাপ আপনাকে বিক্ষিপ্ত করে তোলে।
তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে একই পেশায় থাকার কারণে কোন কাজের পর কোন কাজ করতে হয় তার সবকিছুই আপনার জানা হয়ে যায়। যে কারণে এই কাজে কোনো চ্যালেঞ্জ থাকে না, অথবা নতুন কিছু আবিষ্কার করারও বাসনা থাকে না। তাই অনেক ভেবেচিন্তে নির্বাচন করা পছন্দের পেশাও অসহ্য হয়ে ওঠে।
সৃজনশীল মানুষেরা এমন অবস্থা বেশিদিন মেনে নিতে পারে না। কেননা এমন পরিস্থিতিতে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা স্তব্ধ হয়ে যায়। যার ফলে কাজ এবং সম্মানী ঠিক থাকলেও মানসিক প্রশান্তি থাকে না। এমন অবস্থায় কী করনীয়? নিজের পছন্দের চাকরি কী তাহলে বাদ দিতে হবে? এই চাকরি পরিবর্তন করে অন্য কোনো চাকরি শুরু করতে হবে? কিভাবে এই মধুর সমস্যা মোকাবেলা করা যায়?
আজকের নিবন্ধ এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করব। একসময় খুব আগ্রহ করে শুরু করা চাকরি কেন আপনাকে বিরক্ত করে তোলে? কিভাবে এই পরিস্থিতি নির্ণয় করা যায়?
লক্ষণ চিহ্নিতকরণ
পছন্দের চাকরি কেউ ছাড়তে চায় না। তাছাড়া চাকরির বাজারও খুব চড়া। মন চাইলেই বর্তমান চাকরি ছেড়ে যখন তখন অন্য চাকরিতে যোগ দেওয়া যায় না। তাই শুধুমাত্র সৃজনশীল চর্চা বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে হরহামেশা চাকরি ছাড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
সুতরাং সবার আগে নির্ণয় করতে হবে বর্তমান চাকরিতে আপনার শারীরিক-মানসিক সহ্যের মাত্রা কেমন। একসময় খুব আগ্রহের সাথে শুরু করা বর্তমান চাকরি ছাড়ার জন্য যথেষ্ট কারণ আছে কিনা। সত্যি সত্যি এই চাকরি আপনাকে ধীরে ধীরে অসুখী করে তুলছে কিনা।
নির্ণয় করবেন কিভাবে
আপনি কি সাম্প্রতিক সময়ে কাজে যাওয়ার সবরকম আগ্রহ ও অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলেছেন? অফিসে নির্দিষ্ট কাজ করতে গিয়ে আপনার কখনো হতাশ লাগে? কাঙ্ক্ষিত সম্মানী পাওয়ার পরও নিজের মধ্যে শূন্যতা বোধ হয়? আপনি নিয়ম মেনে কাজ করে যাচ্ছেন অথচ এই কাজ বিশেষ কোনো অর্জন হিসেবে আপনাকে তৃপ্ত করছে না! প্রাথমিকভাবে এইসব লক্ষণগুলো নিজের মধ্যে অনুভূত হলে বুঝতে হবে বর্তমান চাকরিটা আপনার ছাড়া এবং যথাযথ মানসিক প্রশান্তি দেয় এমন একটি নতুন চাকরির সন্ধান করার সময় হয়েছে।
শুধুমাত্র গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ও আত্মবিশ্বাসী কর্মীরাই নিজেদের এই মানসিক অবস্থা মুল্যায়ন করতে পারে। তারা জানে জীবনের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের জন্য কখন এমন চাকরি ত্যাগ করতে হবে। যদি আপনার মধ্যেও এই বিক্ষিপ্ততা কাজ করে তবে পারিবারিক এবং কর্মজীবনের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের কথা মাথায় রেখে দ্রুত আপনার বর্তমান চাকরিটা ত্যাগ করা উচিত। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে আপনি দ্রুত আপনার ম্যানেজারের সাথে কথা বলুন, অথবা স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই এই চাকরি ত্যাগ করুন।
যেসব কর্মীরা নিজের জীবন সম্বন্ধে সচেতন না, নিয়ম মেনে দিনের পর দিন যন্ত্রের মত কাজ করে যায়, তাদের অনেকেই কখনো উপলব্ধি করতে পারে না বর্তমান চাকরি তাকে অসুখী করে তুলেছে! কাঙ্ক্ষিত সেলারি পাওয়ার পরও তারা পরিবার নিয়ে সুখে থাকতে পারে না, নিত্যদিনের সব চাহিদা পূরণ করে হাসিখুশি থাকতে পারে না, পরিবারের সদস্যদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়। সব থাকার পরও মানুষটা জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যতক্ষণ না পর্যন্ত অন্য কেউ তাকে ধরিয়ে দেয় বা কর্মক্ষেত্রে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় ততক্ষণ তারা নিজের অবস্থা উপলব্ধি করতে পারে না।
এমনকি কর্মক্ষেত্রে যখন তারা নিজেদের নাজুক অবস্থা উপলব্ধি করে তখনও এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হিমশিম খায়। অজানা ভয়ের কারণে কঠিন পথ বেছে নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুব খারাপ পরিস্থিতিও তারা ক্ষণস্থায়ী মনে করে, এবং সমগ্র পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনার চেষ্টা করে।
যদিও কর্মক্ষেত্রে যে কোনো পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনার চেষ্টা করা নিঃসন্দেহে কর্মীদের একটি ভালো দিক। তবে যদি সত্যিই পরিস্থিতিটা ক্ষণস্থায়ী হয় তাহলে এই প্রচেষ্টা ঠিকঠাক কাজ করে। কিন্তু আপনি যদি নিজের কাজেই বিরক্ত থাকেন তাহলে এমন ছোট ছোট পরিবর্তন বা প্রচেষ্টা দীর্ঘমেয়াদে কোনো কাজে আসে না। সুতরাং আপনাকে বিচক্ষণতার সাথে নির্ণয় করতে হবে সবকিছু স্বাভাবিক থাকার পরও আপনি আপনার বর্তমান চাকরিতে অসুখী কিনা।
এ ক্ষেত্রে সুখের মাত্রা বিবেচনা করা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। আপনার সব কিছুই আছে তারপরও আপনি কর্ম ও পারিবারিক জীবনে কতটা সুখী তা হিসাব করে দেখুন। দিনের সিংহভাগ সময় আপনার মানসিক অবস্থা কেমন থাকে তা জানুন? মনে রাখবেন, এক্ষেত্রে অর্থ কোনো সমস্যা নয়, সমস্যাটি সম্পূর্ণই মানসিক। আপনার সৃজনশীল মন এবং কর্মের বাস্তবতা এক ধরনের সংঘর্ষ সৃষ্টি করে, যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলশ্রুতিতে কাঙ্ক্ষিত সম্মানী, সুন্দর কর্মপরিবেশ থাকার পরও আপনি কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগী হতে পারেন না।
সমস্যা তখনই সমাধান করা যায় যখন সমস্যাটি সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়। আপনার সার্বিক অসুখী অবস্থার আসল কারণ সতর্কতার সাথে নির্ণয় করুন। নির্ণীত কারণটি যদি আপনার বর্তমান চাকরি হয় তবে আর এক মুহূর্তও বিলম্ব করবেন না। খুব দ্রুতই যেকোন ভাবে এই চাকরি ত্যাগ করে নতুন কোনো চাকরির সন্ধান করুন।
অর্থের কথা চিন্তা করে হয়তো আপনি এই চাকরিতে থেকে যেতে পারেন। কিন্তু এই দ্বান্দ্বিক মানসিক পরিস্থিতি আপনাকে ক্রমশ আরও বেশি অসুস্থ করে তুলবে। সুতরাং বর্তমান চাকরি ও সম্মান থেকেই বা কি হবে যদি তা আপনাকে সুখী করতে না পারে? কেননা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এত কর্মতৎপরতা শুধুমাত্র সুখের জন্য।
আজ এ পর্যন্তই। পরবর্তী নিবন্ধ নিজের দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত চাকরি ছাড়ার কলাকৌশল নিয়ে আলোচনার আশা রাখছি।