চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে আপনি অজস্র প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। তবে এই সব প্রশ্ন দিয়ে শুধু আপনার মেধাকে যাচাই করা হবে না, একই সাথে প্রশ্নগুলো শুনে আপনার ব্যক্তিত্ব কেমন, আপনি কেমন চটজলদি উত্তর দিতে পারেন সেই বিষয়টিও দেখা হয়। ‘নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন’- এই প্রশ্নটি ইন্টারভিউ বোর্ডের সবচাইতে সাধারণ প্রশ্ন হলেও, বেশিরভাগ প্রার্থীই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। কেননা এই প্রশ্নের মাধ্যমে প্রশ্নকর্তারা জানতে পারবেন যে, আপনার ব্যক্তিত্ব কেমন এবং কিভাবে অন্যের সামনে আপনি নিজেকে উপস্থাপন করেন।
মনে করুন, আপনি একটি কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছেন এবং প্রশ্নকর্তা হলো সেই কোম্পানির ম্যানেজার। প্রশ্নকর্তা আপনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার জীবনের কোনো আকর্ষণীয় ঘটনা বলুন যা এই কাজ সম্পর্কিত নয়।
https://youtu.be/d8V4KUnY9dU
ধরা যাক আপনার উত্তর হবে,
“আমি ব্যাঞ্জো বাজাই। এটি বাজাতে আমার খুব ভালো লাগে। আমার সহধর্মিণী একজন গিটারবাদক। আর এই বাদ্যযন্ত্রের সাথে সখ্যতাই আমাদেরকে কর্মজীবনের বাইরে এক অন্য জগতে একসাথে রেখেছে। আমরা শখের বসেই একসাথে বাজাই, কিন্তু এটা করতে আমার আসলেই অনেক ভাল লাগে। আমরা ডজনখানেক গানের সাথে এগুলো বাজাতে পারি, এমনকি আমরা দু’জনে মিলে নিজেদের গানও রচনা করে ফেলেছি!”
এখন, আপনারা কেউ কি বলতে পারবেন যে এখানে কী ভুল আছে?
এবার আরেকটি উত্তর দেখা যাক।
“আমি একজন ব্যাঞ্জোবাদক। আমার ব্লুগ্রাস ঘরানার সংগীত বেশ পছন্দের। তাই আমি ব্যাঞ্জো বাজানো শিখতে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। এটি শেখা আসলেই অনেক কঠিন ছিল, আমি যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি কঠিন। শুরুতে এটি বাজানোর বই কিনে বাজাতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি। এরপর ভিডিও দেখে শেখা শুরু করার পর মনে হলো এবার পারা যাবে। তাই যতদিন না পর্যন্ত একটি পুরো গান বাজাতে পারছিলাম, ততদিন লেগে থাকলাম। এরপর যখন পুরো একটি গানে পারদর্শী হয়ে উঠলাম তখন আশেপাশের মানুষও আমার বাজানোর অনেক প্রশংসা করেছিলো এবং তারা সুর শুনেই বুঝতে পেরেছিল যে আমি কোন গান বাজাচ্ছি।”
আগের উত্তরের চেয়ে এটি কি অধিক ভাল উত্তর নয়? হ্যাঁ, অবশ্যই! দুটো উত্তরই সঠিক কিন্তু প্রথমটি থেকে দ্বিতীয়টি অধিক কার্যকর। কেননা দ্বিতীয়টি থেকে প্রশ্নকর্তা আপনার কাছ থেকে অনেক বিষয় জানতে পারবেন।
প্রথম উত্তরটি থেকে প্রশ্নকর্তা আপনার সম্পর্কে যেসব বিষয় জানবেন-
১. আপনি ব্যাঞ্জো বাজান। (প্রাসঙ্গিক নয়)
২. নিজের সৃজনশীলতা প্রকাশের তেমন সুযোগ পান না। (খুব একটা ভাল লক্ষণ নয়)
৩. আপনি বিবাহিত। (অপ্রাসঙ্গিক তথ্য)
৪. আপনি আপনার ব্যাঞ্জো বাজানোর প্রতিভা সকলের সামনে তুলে ধরতে অধিক আগ্রহী। (জুতসই তথ্য নয়)
৫. আপনার পারিবারিক জীবনে কর্মক্ষেত্র নিয়ে সমস্যা আছে।
দ্বিতীয় উত্তরটি থেকে আপনার সম্পর্কে যা যা জানা যাবে-
১. আপনি নতুন কিছু শেখার জন্য উৎসাহী হয়েছেন। (ভাল)
২. নিজের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সৎ। (ভাল)
৩. নিজের ব্যর্থতার কাহিনী শোনাতে সংকোচবোধ করেননি। (ভাল)
৪. হাত-পা না গুটিয়ে রেখে শেখার উপায় খুঁজে বের করেছেন। (ভাল)
৫. একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে সেই অনুযায়ী সামনে এগিয়েছেন। (ভাল)
৬. নিজের কাজ কেমন হয়েছে তা একজন সমালোচোকের দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। (ভাল)
এসব কারণেই ২য় উত্তরটি অধিক কার্যকর। শুধুমাত্র নিজের গল্প বললেই হবে না, এমনভাবে তা সবার সামনে উপস্থাপন করতে হবে যাতে তা থেকে সবাই আপনার সম্পর্কে ভালো কিছু জানতে পারে।
কেননা সব কোম্পানি শুধু মাত্র দক্ষ কর্মী নিতে চায় না, তাদের কাজ করার পাশাপাশি আর কী কী করতে ভাল লাগে; সেগুলো জানাও আবশ্যক মনে করে। তারা কোনো একঘেয়ে কর্মী নিতে চায় না। একঘেয়ে কর্মীরা খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে কোনো রসকষও থাকে না। কিন্তু কাজ ছাড়াও অন্যান্য আরো অনেক দিকে যেসব কর্মীর আকর্ষণ আছে, তাদেরকে খুব সহজেই আলাদা করে নেওয়া যায়। তারা সবসময় সাবলীল এবং ফুরফুরে থাকেন। নিত্যনতুন জিনিসের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আর এ কারণেই তারা অন্যদের থেকে দক্ষ হয়ে ওঠেন।
মনে করুন, আপনি একজন স্কুল শিক্ষক। একজন স্কুল শিক্ষক হওয়ার জন্য যেসকল গুণাবলী প্রয়োজন, তার সবটাই আপনার আছে। আপনার সাথে শিক্ষকের চাকরি নিতে আরো একজন প্রার্থী রয়েছে, আর তারও রয়েছে শিক্ষকতা করার যোগ্যতা। আপনাদের দুজনের সাথে বোর্ড কর্মকর্তারা কথা বলে জানতে পারলেন যে, আপনি অফিস ম্যানেজমেন্টের কাজ জানেন এবং সেই সাথে গ্রাফিক্সের কাজও পারেন। তাহলে অবশ্যই সেই প্রার্থীকে বাদ দিয়ে তারা আপনাকেই নিয়োগ দিবেন। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আপনাকে অবশ্যই আপনার এই দক্ষতার কথা ঘটনা ২ এর মতন তুলে ধরতে হবে।
বিখ্যাত লেখক সিমন স্নিকস তার ‘স্টার্ট উইথ হোয়াই’ এ বলেছেন:
“People don’t buy WHAT you do, they buy WHY you do it.”
অর্থাৎ মানুষ আপনার কাছে জানতে চাইবে না যে আপনি কি করেছেন। বরং জানতে চাইবে যে আপনি এটা কেন করেছেন।
ম্যানেজার আপনাকে তার কোম্পানিতে এই কারণে নেবেন না যে, আপনি ব্যাঞ্জো বাজান। কিন্তু আপনি যদি দ্বিতীয় উত্তরটির মতন উত্তর দেন, তাহলে আপনাকে তারা অবশ্যই নেবেন। এটা বোঝা একটু মুশকিল, কেননা তারা আপনার মতন এরকম অসংখ্য চাকরিপ্রার্থীদের মুখোমুখি হন এবং কে কার থেকে আলাদা তা বের করতে নানান রকমের প্রশ্ন করতে হয়। কিন্তু আপনার উত্তর যদি ২য়টা হয় তাহলে তারা আপনাকে নিতে বাধ্য!