ঘুম হচ্ছে শান্তির কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই ঘুমের সাথে আমরা পরিচিত। কিন্তু এই ঘুমের মাঝেই লুকিয়ে আছে নানান ধরণের রহস্য। আমাদের মাঝে অধিকাংশই ঘুমের মাঝে নানান ধরণের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। ধরুন, আপনি গভীর ঘুমে হঠাৎ আপনার মনে হলো আপনি খুব উঁচু থেকে পড়ে যাচ্ছেন, তখন কেমন লাগবে? স্বাভাবিকভাবেই আপনি ঘাবড়ে যাবেন এবং ঘুম থেকে জেগে উঠবেন। চলুন জেনে নেয়া যাক কেন এমনটি হয়।
হাইপনিক জার্ক কী?
আমাদের মাঝে অনেকেরই ঘুমের সমস্যা আছে, ঘুম ঠিকমতো না আসা কিংবা অনেক দেরী করে ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস। এর মাঝে যদি আপনার সাথে এমনটি হয় তবে তা অবশ্যই খুব মেজাজ খারাপের কারণ হবে। এই অনুভূতিটা খুবই প্রবল। সাথে সাথে আপনার হৃদকম্পন কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। আপনি ঘামতে শুরু করতে পারেন, কিন্তু এটি খুবই কম সময় স্থায়ী হয়ে থাকে। আপনার হঠাৎই মনে হবে আপনি আপনার বিছানা কিংবা কোনো উঁচু স্থান থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছেন এবং আপনার জীবন হঠাৎ থেমে যাচ্ছে এমনও মনে হতে পারে।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে পাওয়া গিয়েছে যে, শতকরা ৭০ জন মানুষ ঘুমের মাঝে এমন অনুভূত করেছেন। যদিও এরকম কিছু হওয়াটা ক্ষতি কিংবা চিন্তার কোনো কারণ নয়। এই সমস্যাটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। Hypnic Jerk, Hypnagogic jerk, Sleep Start কিংবা Sleep Twitch।
কেন এমন হয়?
আপনার সাথে এমনটি হবার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে নানা কারণ। যারা অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যাফেইন গ্রহণ করেন, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভুগছেন, অনিদ্রা কিংবা খুব পরিশ্রমের কাজ করে থাকেন তবে তাদের সাথে এমন ঘটনা ঘটার প্রবণতা বেশী থাকে। মূলত আমরা যদি একটানা কোনো কাজ করতে থাকি, নিজের শরীর এবং মস্তিষ্ককে বিশ্রাম না দিই তবে এমন ঘটনা ঘটে থাকে। আপনার শারীরিক এবং মানসিক শান্তির বিঘ্ন ঘটছে, এই ঘটনাটি তারই প্রমাণ।
বিভিন্ন গবেষকরা এই ঘটনার পিছনের বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছেন। ড. মাইকেল ব্রুস বলেন যে, এর পিছনে দুইটি কারণ থাকতে পারে। আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি তখন আমাদের সকল পেশী শিথিল হতে থাকে। তখন আমাদের মস্তিষ্ক এই ব্যাপারটি ঠিকমত বুঝতে না পেরে আমাদেরকে এরকম অনুভূতি প্রদান করে। আবার আরেকটি কারণ হলো আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি তখন আমাদের নার্ভাস সিস্টেম ও কাজ করা বন্ধ করে এবং এটি যখন হয় তখন আমরা হঠাৎ শরীরে কম্পন অনুভব করি।
একজন মনোবিশেষজ্ঞ, টম স্ট্যাফর্ড বলেন, হাইপনিক জার্ক কেন হয় কিংবা এর পিছনের আসল রহস্য কী তা আমরা কেউই জানি না।
এই হাইপনিক জার্ক মূলত অনিচ্ছাকৃত পেশী টুইস্টের জন্য হয়ে থাকে। এটিকে মাইক্লোনাসও বলা হয়ে থাকে। এই ঘুমের মাঝে হঠাৎ করে পড়ে যাওয়া মনে হওয়াটা সবার কাছেই রহস্য। কিন্তু এর জন্য আরো অনেক ধরনের থিওরি প্রচলিত রয়েছে। যেমন অনেকে এমনও বলে থাকেন যে, আমাদের মস্তিষ্কে কুস্তি লড়াই চলে যার জন্য এমন অনুভূত হয়। আরেকটি তত্ত্ব রয়েছে যেটা বিবর্তনীয় আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনোবিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক কুলিজ প্রস্তাব করেন যে, হাইপনিক জার্ক “মস্তিষ্কের স্মৃতির অপ্রত্যাশিত স্মৃতির অপ্রত্যাশিত একটি মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ হতে পারে যা ঘুমের প্রবণতার সাথে একটি ঘুমের প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে।”
কেমন অনুভূত হয় হাপনিক জার্ক হলে?
৪৪ বছর বয়সী এক ব্রিটিশ নাগরিক জ্যাকুই প্যাটারসন প্রায় গত তিন বছর ধরে এই সমস্যায় ভুগছেন। প্রতি রাতেই তার সাথে এই ঘটনা ঘটছে যার জন্য তার ঘুমের প্রচন্ড ব্যাঘাত ঘটে। তিনি বলেন,”আমি যখন ৪১ বছর বয়সী তখন থেকেই আমি ইনসমনিয়াতে (রাতে ঘুম না আসা) আক্রান্ত। আগে আমার সাথে এরকম কখনোই হয় নি। প্রথম প্রথম আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না, জেগে থাকতাম। কিন্তু এরপর প্রায় প্রতি রাতে ঘুমানোর এক ঘন্টার মাঝেই আমার ঘুম ভেঙে যায়, মনে হয় আমি অনেক উঁচু কোনো দালান থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছি। এটি ঠিক যেন এলার্মের মতো, ঘুমানোর এক ঘন্টার মাঝেই ঘুম ভেঙ্গে যায়।”
তিনি বলেন যে, এই ব্যাপারটি তার সাথে তখনই বেশী ঘটে যখন তিনি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত থাকেন। তিনি যদি ঘুমানোর আগে এই ভেবে ঘুমান যে, উঠার পর তার কী কী কাজ করতে হবে, বা কী ঘটতে যাচ্ছে তখন মোটামুটি নিশ্চিত যে তার রাতে হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে ঘুম ভেঙ্গে যাবে।
এই কাঁপুনি অনেকটা ইলেকট্রিক শকের মতো। প্যাটারসন আরো বলেন,”আমি অনেকের কাছে এই অনুভূতির কথা শুনেছি, তারা মাঝেমধ্যেই ঘুমের সময় এমন কাঁপুনির সম্মুখীন হয়। তাদের কাছে মনে হয় যে, তারা অনেক উঁচু দালান থেকে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে এর অনুভূতি একটু ভিন্ন। আমার কাছে মনে হয়-কেউ আমাকে এসে সজোরে চড় দিয়েছে। আবার অনেক সময় মনে হয় আমি ঠান্ডা বরফ পানিতে লাফ দিচ্ছি। আমি প্রতিবারই এরকম অনুভূত হলে সজাগ হয়ে যাই এবং পরবর্তীতে আর ঘুম আসে না।”
কিভাবে এর সমাধান করা সম্ভব?
এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ রয়েছে, বিশেষত ঘুমের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে। আপনি যত ভালোভাবে ঘুমাতে পারবেন বা ঘুমানোর চেষ্টা করবেন তত তাড়াতাড়ি এর সমাধান হবে। উইলসন বলেন,”ঘুমের রুটিন ঠিক করতে পারলেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।” তিনি আরো বলেন,”প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং একই সময় ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস করুন। আর প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে যেসব কাজ করবেন তা যেন আপনাকে মানসিক শান্তি প্রদান করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।”
এই সমস্যাটি খুব একটা গুরুতর নয়। আমরা অনেক সময়ই কাজের চাপে ঠিকমত বিশ্রাম নিতে পারি না। সেক্ষেত্রে এরকম হতেই পারে। কিন্তু যদি এটি ঘুমের অনেক বেশি ব্যাঘাত ঘটায় সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়াই শ্রেয়। কেননা ঘুম আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শারীরিক এবং মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হয় যদি ঠিকমত ঘুম না হয়। সেক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশী হতে থাকলে দেরী না করে ডাক্তারের সাথে কথা বলে পরামর্শ মতো চলুন।