ফুটবলে ১১ জন খেলোয়াড় নিয়ে দল গঠিত হয়। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোল করার দায়িত্ব থাকে আক্রমণভাগের উপর। বিশ্বের প্রতিটি ফুটবল দল তাদের আক্রমণভাগকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সে কারণেই ফুটবলে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের সবচেয়ে বেশি দাম। যে দলের আক্রমণভাগ যত বেশি শক্তিশালী, সেই দল খেলায় অধিক আধিপত্য বিস্তার করে খেলতে পারে। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক এবং ক্লাব ফুটবলে দারুণ কিছু আক্রমণভাগ দেখা গিয়েছে। তার মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে সেরা ১০টি আক্রমণাত্মক দল। তাহলে দেখে নেওয়া যাক কোন ১০টি দলের ক্ষুরধার সবচেয়ে বেশি।

১৯৭৭ থেকে ১৯৮৪ সালের লিভারপুল

বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল দল লিভারপুল। লিভারপুলের ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত খেলা দলটি ছিলো ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম আক্রমণাত্মক ফুটবল দল। বব পেইসলির অধীনে লিভারপুলের এই সময়ের দলটি হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য। লিভারপুলের এই দলটি ৪টি ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিলো যা লিভারপুলের ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা অর্জন।

১৯৮৪ সালের লিভারপুল; Source: liverpoolfc.wikia.com

সেই সময়ের ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের সবচেয়ে সেরা দল ছিলো লিভারপুল। বব পেইসলির দলে ছিলেন কেনি ড্যালগ্লিশ, ইয়ান রাশ এবং কেভিন কিগানের মতো মারাত্মক সব স্ট্রাইকার। বব পেইসলি ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি এমন এক দল তৈরি করেন যেটি প্রতিপক্ষের জন্য ছিলো ভয়ংকর।

১৯৮৬ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা

১৯৮৬ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা দল সন্দেহাতীতভাবে সর্বকালের অন্যতম সেরা এক ফুটবল দল। অসাধারণ আক্রমণভাগের আর্জেন্টিনার এই দলকে ফুটবল ভক্তরা চিরদিন মনে রাখবে। ‘৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলে ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা, জর্জ ভালদানো, জর্জ বুরুচাগা এবং হেক্টর এনরিকের মতো ফুটবলার।

আর্জেন্টিনার ১৯৮৬ বিশ্বকাপ দল; Source: fifaworldcupevent.com

১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৩-২ গোলে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি। আর্জেন্টিনার ১৯৮৬ বিশ্বকাপ দলকে যেমন মনে রাখবে ফুটবল ভক্তরা তেমনি মনে রাখবে তাদের প্রতিপক্ষরা। বিশেষ করে ইংল্যান্ড।

‘৭০ এর দশকের নেদারল্যান্ড

‘৭০ এর দশকের সেরা ফুটবল দল ছিলো নেদারল্যান্ড। ট্রফি বাদ দিয়ে যদি খেলার মানের উপর ভিত্তি করে কোনো সেরা দল বাছাই করা হয় তবে ১৯৭০ দশকের নেদারল্যান্ড ছিলো ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা দল। ১৯৭০ দশক থেকে ‘টোটাল ফুটবল‘ দর্শনের উপর ভিত্তি করে আমূল পরিবর্তন হয় নেদারল্যান্ডের।

নেদারল্যান্ডের ১৯৭৪ বিশ্বকাপ দল; Source: soccerpro.com

রাইনাস মাইকেলসের অধীনে নেদারল্যান্ড নিজেদের ফুটবল পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার নিজেদেরকে বিশ্বের অন্যতম সেরা এক ফুটবল দলে পরিণত করেন। ১৯৭০ দশকের সেরা এই ফুটবল দলটি দুঃখজনকভাবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ শিরোপা জয় করতে পারেনি। বিশ্বের অন্যতম আক্রমণাত্মক এই দলটি ১৯৭৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে ২-১ গোলে হেরে শিরোপার স্বপ্ন বিলীন করে দেয়।

১৯৭০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল

১৯৭০ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দলকে ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা দল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭০ বিশ্বকাপের এই দলটি প্রতিটি বিভাগে সেরা ছিলো। বিশেষ করে আক্রমণভাগ ছিলো অতুলনীয়। আক্রমণভাগে ছিলেন পেলে, জাইরজিনহো, তোসতাও, রিভেলিনো এবং কার্লোস আলবার্তোর মতো সেরা সেরা খেলোয়াড়।

ব্রাজিলের ১৯৭০ বিশ্বকাপ দল; Source: fifa.com

জাইরজিনহো ১৯৭০ বিশ্বকাপের প্রতিটি রাউন্ডে গোল করার রেকর্ড গড়েছিলেন, যে রেকর্ড এখন পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি। ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ব্রাজিল।

২০০৩-০৪ মৌসুমের আর্সেনাল

২০০৩-০৪ মৌসুমে আর্সেলানের যে আক্রমণভাগ ছিলো সেটি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম মারাত্মক আক্রমণভাগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফ্রেঞ্চ তারকা থিয়েরি অঁরি, রবার্ট পিরেস এবং ফ্রেডি লুংবার্গরা নিয়মিত গোল করতেন। থিয়েরি অঁরিদের কাছে অন্যরা পাত্তাই পায়নি।

২০০৩-০৪ মৌসুমে শিরোপা জয়ের পর ট্রফি হাতে আর্সেনালের খেলোয়াড়দের উল্লাস; Source: joe.ie

আর্সেনালের ইতিহাস সেরা আক্রমণভাগ শুধুমাত্র শিরোপাই জেতায়নি, সেই সাথে টানা ৩৮ ম্যাচ অপরাজিত ছিলো। আর্সেনালের সেই সময়কার আক্রমণভাগ এতটাই শক্তিশালী ছিলো যে, তারা ইতালিয়ান জায়ান্ট ইন্টার মিলানকে ৫-১ গোলে বিধ্বস্ত করেছিলো। বর্তমানে আর্সেনালের অবস্থা খারাপ হলেও, সেই দিনগুলোতে আর্সেনাল ছিলো সবসময় শিরোপার দাবিদার।

১৯৯৯-২০০০ মৌসুমের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাব। জনপ্রিয়তার পারদ এখনো খু্ব বেশি নামেনি। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে ম্যানইউ ‘ট্রেবল’ জিতেছিলো। কিন্তু পরের মৌসুমে অর্থাৎ ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে ম্যানইউয়ের খেলোয়াড়রা গোলের ঝাঁপি খুলে বসেছিলো। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের শিষ্যরা প্রিমিয়ার লিগে এক মৌসুমে রেকর্ড ৯৭টি গোল করেছিলো।

১৯৯৯-২০০০ মৌসুমের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড; Source: squawka.com

ম্যানইউয়ের আক্রমণভাগের খেলোয়াড় ডোয়াইট ইয়র্ক, অ্যান্ডি কোল, ওলে গানার সলশেয়ার তো নিয়মিত গোল করতেনই, সেই সাথে ডেভিড বেকহাম, রায়ান গিগস, রয় কিন এবং পল স্কোলসও বিভিন্ন সময়ে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়াতেন। ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে ম্যানইউ ছিলো সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ১৮ পয়েন্টের ব্যবধানে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা ওল্ড ট্রাফোর্ডের ঘরে তোলে ম্যানইউ।

২০১১-১২ মৌসুমের বার্সেলোনা

পেপ গার্দিওলা ২০১১-১২ মৌসুমে বার্সায় কোচিং ক্যারিয়ারের ইতি ঘটান। শেষ বারের মতো বার্সার ড্রাগ আউটে দাঁড়িয়ে তার শিষ্যদের ফুটবল প্রতিভার সাক্ষী হন এবং দিক-নির্দেশনা দেন। ২০১১-১২ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনাই লা লিগার শিরোপা প্রত্যাশী ছিলো।

২০১১-১২ মৌসুমের বার্সেলোনা; Source: telegraph.co.uk

তবে ২০১১-১২ মৌসুমে বার্সা খেলোয়াড়রা প্রচুর সংখ্যক গোল করেছিলো। সকল টুর্নামেন্ট মিলিয়ে বার্সা ১৯০টি গোল করেছিল। বোঝাই যাচ্ছে, কতটা আক্রমণাত্মক ছিলো ঐ মৌসুমের বার্সা। লিওনেল মেসি ৭৩ গোল করে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর চেয়ে ১৩ গোল এগিয়ে থেকে মৌসুম শেষ করেছিলেন। গোল শুধু মেসিই করেননি, সেই সাথে সেস্ক ফ্যাব্রিগাস, জাভি, পেদ্রো এবং অ্যালেক্সিস সানচেজ ১৩ বা তার বেশি গোল করেছিলেন। কিন্তু বার্সেলোনার এই ধারালো আক্রমণভাগও শিরোপা জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিলো না। গার্দিওলার শেষ মৌসুমে তারা লা লিগা বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ কোনোটিই জিততে পারেনি।

১৯৯৪-৯৫ মৌসুমের আয়াক্স

একসময় ইউরোপের অন্যতম জায়ান্ট ছিলো আয়াক্স। বিশেষ করে ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে লুই ভ্যান গালের অধীনের আয়াক্স ছিলো অপ্রতিরোধ্য। সেই কারণে লুই ভ্যান গাল যখন ম্যানইউতে কোচ হিসেবে আসেন তখন ইংলিশ ক্লাবটির সমর্থকরা ভেবেছিলেন এবার ম্যানইউও হয়তো অপ্রতিরোধ্য হবে। কিন্তু সেটা হয়নি।

১৯৯৪-৯৫ মৌসুমের আজাক্স; Source: twitter.com

কারণ আয়াক্সে সেই সময়ে ছিলো দারুণ কিছু ফুটবলার। আমস্টারডামের ক্লাবটি ঘরোয়া লিগে মোট ১০৬টি গোল করে ৭ পয়েন্টের ব্যবধানে শিরোপা জিতে নেয়। সেই সাথে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপাও জিতে নেয় নেদারল্যান্ডের সেরা এই ক্লাবটি। ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে আয়াক্সের ফরোয়ার্ডদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা। ফলে দেশ সেরা হওয়ারর পাশাপাশি ইউরোপ সেরাও হয় আয়াক্স।

২০১১-১২ মৌসুমের রিয়াল মাদ্রিদ

২০১১-১২ মৌসুম হোসে মরিনহো এবং রিয়াল মাদ্রিদের জন্য ছিলো অসাধারণ একটি মৌসুম। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে দারুণ একটি বছর কাটান হোসে মরিনহো। তার দলের খেলোয়াড়রা লা লিগায় ৩৮ ম্যাচে ১২১টি গোল করেছিলো। পুরো মৌসুমে রিয়ালের খেলোয়াড়রা মোট ১৭৪ বার প্রতিপক্ষের জালে বল জড়ান। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সব ধরণের প্রতিযোগিতায় ৬০টি গোল করেছিলেন।

২০১১-১২ মৌসুমের রিয়াল মাদ্রিদ; Source: centrocampista.com

সেই সাথে করিম বেনজেমা এবং গঞ্জালো হিগুয়েইন যথাক্রমে ৩২টি এবং ২৬টি করেছিলেন। রিয়ালের আক্রমণভাগের সেরা ৩ খেলোয়াড়ের পারফর্মেন্স ছিলো অনবদ্য। ২০১১-১২ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ পয়েন্টের ‘শতক’ স্পর্শ করে ৩২তম লা লিগা শিরোপা জিতে নেয়।

২০০৯-১০ মৌসুমের চেলসি

লন্ডনের ক্লাব চেলসি ইংলিশ ফুটবলের এক পরাশক্তি। চেলসি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে দারুণ কিছু মৌসুম কাটিয়েছে। তার মধ্যে ২০০৯-১০ মৌসুম ছিলো চেলসির জন্য অন্যতম সেরা একটি মৌসুম। ইতালিয়ান কোচ কার্লো আনচেলেত্তির অধীনে চেলসি প্রিমিয়ার লিগের প্রথম দল হিসেবে এক মৌসুমে ১০০ গোল করার রেকর্ড গড়ে। চেলসির গোলমেশিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দ্রিদিয়ের দ্রগবা এবং নিকোলাস আনেলকা।

২০০৯-১০ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন চেলসি; Source: telegraph.co.uk

২০০৯-১০ মৌসুমে চেলসির প্রতি ম্যাচে গোল গড় ছিল ২.৭১। মৌসুমের শেষ ম্যাচে চেলসি উইগানকে ৮-০ ব্যবধানে হারিয়ে তার ক্ষমতা আরও একবার জানান দেয়। রেকর্ড পরিমাণ গোল করে চেলসি প্রিমিয়ার লিগের তৃতীয় শিরোপা ঘরে তোলে।

Featured Image: centrocampista.com

 

SOURCE: GLAM.WORLD