মাশরাফিঃ এক জীবন্ত যোদ্ধার নাম

0

মাশরাফিঃ এক জীবন্ত যোদ্ধার নাম

 

তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের (ODI) অধিনায়ক এবং অন্যতম বোলিং স্তম্ভ।  ১৬ কোটি মানুষের গর্ব। অনেকে তাকে জীবন্ত যোদ্ধাও বলে। ধৈর্য, সাহস, নেতৃত্ব  আর উদারতা দিয়ে জয় করেছেন কোটি মানুষের হৃদয়। তিনি সবার প্রিয় মাশরাফি বিন মর্তুজা

১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা নড়াইল-এ মাশরাফির জন্ম। ডাক নাম কৌশিক। ছোট বেলাটা কেটেছে তাঁর হই-হুল্লোড় আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে। তিনি বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেটের মধ্যমনি হলেও এক সময় ব্যাডমিন্টন, ফুটবল  খেলতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। সুযোগ পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে দল বেধে চিত্রা নদীতে সাঁতার কাটা ছাড়াও বই হাতে স্কুল পালাতেন। তারুণ্যের শুরুতে ক্রিকেটের প্রতি তার আগ্রহ জন্মে, বিশেষত ব্যাটিংয়ে; যদিও এখন বোলার হিসেবেই তিনি বেশি খ্যাত, যেজন্যে তাকে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ নামেও অভিহিত করা হয়।

বাইকপ্রিয় মর্তুজাকে সবাই খুব হাসিখুশি আর উদারচেতা মানুষ হিসেবেই জানে। প্রায়শঃই তিনি বাইক নিয়ে স্থানীয় ব্রিজের এপার-ওপার চক্কর মেরে আসেন। নিজের শহরে তিনি প্রচণ্ড রকমের জনপ্রিয়। এখানে তাকে প্রিন্স অব হার্টস বলা হয়। এ শহরের-ই সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় সুমনা হক সুমির সাথে তার পরিচয় হয়। দু’জনে ২০০৬ সালে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।

প্রেমভালোবাসা এবং বিয়ে

নড়াইলের ছোট্ট শহরের পাশেই ছোটবেলা কেটেছে মাশরাফি বিন মর্তুজার। একই গ্রামের মেয়ে সুমনা হক সুমির সঙ্গে তখন থেকেই প্রেমের সম্পর্ক মাশরাফির। এলাকার কারও অজানা ছিল না মাশরাফি ও সুমির প্রেমকাহিনী। সাদা মনের মাশরাফির প্রতিভার বিকাশ হতে সময় লাগেনি মোটেও। বাংলাদেশ দলে সুযোগ পেয়েই হলেন বড় তারকা। গ্রামের মানুষের মধ্যে তখন সন্দেহ। সুমির বাবাকে প্রতিবেশীরা বোঝাতে চাইলেন- তার মেয়েকে বিয়ে করবেন না মাশরাফি। ও এখন বড় তারকা। প্রতিবেশীদের এমন কথায় মাশরাফির বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন সুমির বাবা। রাজি হয়ে যান দু’জনেই। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিয়ে হয় তাদের। বর্তমানে মাশরাফি দুই সন্তানের জনক। মেয়ে হুমাইরা এবং ছেলে সাহেলকে  নিয়ে সুখের সংসার তাদের।

প্রাথমিক ক্যারিয়ার

মর্তুজা বাংলাদেশের সফলতম পেস বোলারদের একজন। আক্রমণাত্মক, গতিময় বোলিং দিয়ে অনূর্ধ-১৯ দলে থাকতেই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সাবেক ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টসের নজর  কেড়েছিলেন, যিনি কিনা তখন দলটির অস্থায়ী বোলিং কোচের দায়িত্বে ছিলেন। রবার্টসের পরামর্শে মাশরাফিকে বাংলাদেশ এ-দলে নেয়া হয়। বাংলাদেশ এ-দলের হয়ে একটিমাত্র ম্যাচ খেলেই মাশরাফি জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান।

  • নভেম্বর, ২০০১ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টেস্ট ক্রিকেটে তার অভিষেক ঘটে। একই ম্যাচে খালেদ মাহমুদেরও অভিষেক হয়। বৃষ্টির বাগড়ায় ম্যাচটি অমীমাংসিত থেকে যায়। মাশরাফি অবশ্য অভিষেকেই তার জাত চিনিয়ে দেন ১০৬ রানে ৪টি উইকেট নিয়ে। গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার ছিলেন তার প্রথম শিকার। মজার ব্যাপার হল, মাশরাফির প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচও ছিল এটি তিনি এই বিরল কৃতিত্বের অধিকারী ৩১তম খেলোয়াড় এবং ১৮৯৯ সালের পর তৃতীয়

 

  • একই বছর ২৩শে নভেম্বর ওয়ানডে ক্রিকেটে মাশরাফির অভিষেক হয়। অভিষেক ম্যাচে মোহাম্মদ শরীফের সাথে বোলিং ওপেন করে তিনি ৮ ওভার ২ বলে ২৬ রান দিয়ে বাগিয়ে নেন ২টি উইকেট।

 

 

  • ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যক্তিগত তৃতীয় টেস্ট খেলার সময় তিনি হাঁটুতে আঘাত পান। এর ফলে তিনি প্রায় দু’বছর ক্রিকেটের বাইরে থাকতে বাধ্য হন। ইংল্যন্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্ট খেলায় তিনি সফলতা পান। ৬০ রানে ৪ উইকেট নেয়ার পর আবার তিনি হাঁটুতে আঘাত পান। এ যাত্রায় তিনি প্রায় বছরখানেক মাঠের বাইরে থাকতে বাধ্য হন।
  • ২০০৪ সালে ভারতের বিরুদ্ধে খেলার সময় রাহুল দ্রাবিড়কে অফ-স্ট্যাম্পের বাইরের একটি বলে আউট করে তিনি স্বরুপে ফেরার ঘোষণা দেন। এই সিরিজের একটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে অবিস্মরণীয় জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি।
  • ২০০৬ সালে নাইরোবিতে কেনিয়ার বিরুদ্ধে ২৬ রানে উইকেট মাশরাফির সেরা সাফল্য
  • কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নাটকীয় জয়ে তিনি অবদান রাখেন। তিনি মারকুটে ব্যাটসম্যান অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে শূন্য রানে আউট করেন এবং দশ ওভারে মাত্র ৩৩ রান দেন।

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে ভালো পেস বোলারের ঘাটতি ছিল। বাংলাদেশে মোহাম্মদ রফিকের মত আন্তর্জাতিক মানের স্পিনার থাকলেও উল্লেখযোগ্য কোন পেস বোলার ছিল না। মাশরাফি বাংলাদেশের সেই শূন্যস্থান পূরণ করেন

  • ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বাধিক উইকেট শিকারীর খেতাব অর্জন করেন মাশরাফি। সেই বছর তিনি অর্জন করেন ৪৯টি উইকেট।
  • ২০০৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় জয়ে মর্তুজা মূখ্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ৩৮ রানে ৪ উইকেট দখল করেন।
  • মাশরাফি শুধু একজন ভাল বোলার নন তিনি একজন মারকুটে ব্যাটসম্যান। ভারতের বিপক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় তিনি পরপর চার বলে ছক্কা পেটান। সেই ওভার থেকে তিনি ২৬ রান সংগ্রহ করেন যা কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের জন্য এক ওভারে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড
  • ২০১০ সালে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সময় ইনজুরিতে পড়েন। এই ইনজুরির কারনে তিনি ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলতে পারেনি।
  • ঘরোয়া ক্রিকেটের বাইরে ভারতের আইপিএল-এ কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলেছেন।

ইনজুরিকে জয় এবং এগিয়ে যাওয়া

১৪ বছরের ক্যারিয়ারে ১১ বার চোটের কারণে দলের বাইরে যেতে হয়েছে মাশরাফিকে। শেন বন্ড, এন্ড্রু ফ্লিনটফের মত বাঘা বাঘা বোলাররা যখন ইনজুরির কারণে ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছিল মাশরাফি তখন সেই ইনজুরিকে জয় করে আবারো ফিরে আসে নতুন রূপে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। ২০১৪ সালে অধিনায়ক হবার পর থেকে তার নেতৃত্বে বদলে যায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। বাংলাদেশ ক্রিকেটের গত দেড় বছরের অর্জন মাশরাফির বদৌলতে।

  • ওয়ানডে র‍্যাংকিং এ সাত নম্বরে আসা সহজ কথা নয়। এক সময় আমাদের কাছে ছিল এটি স্বপ্নের মত। সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার নেতৃত্বে।
  • বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে প্রথমবারের মত কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার গৌরব অর্জন করে মাশরাফির নেতৃত্বে।
  • শুধু তাই নয় ইংল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মত পরাক্রমশালীদের পরাজিত করা, এশিয়া কাপে রানার আপ এবং চ্যাম্পিয়নস্ ট্রফিতে সেমিফাইনালিস্ট হওয়া – সবই পেয়েছে বাংলাদেশ এই মাশরাফির নেতৃত্বে।
  • এছাড়াও তার নেতৃত্বে ঢাকা ডাইনামাইট এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস্ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়
  • ২০১৬ সালের রকেট বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় খেলায় ২ উইকেট সংগ্রহের মাধ্যমে মোট ২১৬ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারী হিসাবে তুলে ধরেন নিজেকে

২০১৭ সালে ৬ই এপ্রিল বাংলাদেশ  শ্রীলংকা সিরিজের শেষ টি২০ দিয়ে মাশরাফি আন্তর্জাতিক টি২০ খেলা থেকে অবসর নেন। মাঠে ম্যাশ নামে পরিচিত মাশরাফি বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার যিনি অধিনায়ক থাকা অবস্থায় অবসর নেন।

অদম্য ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য আর পরিশ্রমের মাধ্যমে সব বাঁধা জয় করে যে, সফলতার স্বর্ণ শিখরে  পৌছানো যায়, শত প্রতিকূলতায় বার বার হারিয়ে যেয়েও যে, সগৌরবে ফিরে আসা যায়, কোটি কোটি মানুষকে নতুন সম্ভবনার স্বপ্ন দেখানো যায় তার জীবন্ত উদাহরণ আমাদের মাশরাফি। এই জীবন্ত যোদ্ধা সারাজীবন বেঁচে থাকবে কোটি মানুষের হৃদয়ে।

 

মোঃ দেলোয়ার জাহান সোহাগ

সভাপতি চুয়েট ক্যারিয়ার ক্লাব &

কমিউনিকেশন ম্যানেজার, ইয়ুথ কার্নিভাল

তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া; মাশরাফি- দেবব্রত মুখোপাধ্যায়

 

মাশরাফির সাথে পৃথিবীর কোনো খেলোয়াড় এর তুলনা চলেনা, তার তুলনা সে নিজেই

ডেভ হোয়াটমোর বলেছিলেন “মাশরাফির সাথে পৃথিবীর কোনো খেলোয়াড় এর তুলনা চলেনা, তার তুলনা সে নিজেই”  কারন:


■■ নিউজিল্যান্ডের গতিদানব ‘শেন বন্ড’ দুইবার সার্জারীর পরই ভয়ে ক্রিকেট ছেড়ে দেন…


■■ বিশ্ববিখ্যাত ইংলিশঅলরাউন্ডার ‘এন্ড্রু ফ্লিন্টফ’ মাত্র একটি সার্জারীর ভয়েই ক্রিকেট কে গুডবাই জানিয়েছেন…


■■ একমাত্র ক্রিকেটার যিনি পরপর ৭টা মারাত্নক সার্জারী করেও এখনো ক্রিকেট চালিয়ে যাচ্ছেন………
বিশ্বের কোন ফার্স্ট বোলারই দুইবারের বেশি সার্জারী করে খেলতে পারেননি কিন্তু তিনিই এই অসাধ্য ব্যাপার সাধ্য করেছেন ।


■■ একমাত্র পরিশ্রমী ক্রিকেটার যার ওজন বেড়ে যাচ্ছে বলে ক্রিকেট ছাড়ার আশংকা ছিল তাই তিনি ১মাসে ১২ কেজী ওজন কমিয়ে সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়েছিলেন।


■■ যেকোন আঘাতে তাঁর বাম পা পঙ্গু হয়ে যেতে পারে এমন রিস্ক থাকা সত্ত্বেও তিনিই একমাত্র সাহসী মানব যিনি প্রতিটি ম্যাচে এখনো হিংস্র বাঘের মত বোলিং করে যাচ্ছেন !


■■ তিনিই একমাত্র দেশপ্রেমিক যার একমাত্র আদরের ৫ মাস বয়সী ছেলে এ্যপোলো হাসপাতালে ভর্তি হয়ে টাইফয়েডের সঙ্গে মূত্রাশয়ের সংক্রমণ রোগে মৃত্যুর মুখো-মুখি, অথচ দেশের স্বার্থে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে একমাত্র ছেলের সুস্থ্যতার জন্য দু’হাত তুলেদোয়া করে দেশের জন্য মাঠে নেমেছেন।


■■ একমাত্র ক্রিকেটার যে প্রতি ম্যাচ শেষে হাটুতে জমে যাওয়া রস নিজে সিরিঞ্জ দিয়ে বের করে ফেলেন।


■■ তিনিই সেই ক্রিকেটার যার প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গার পর ১৫মিনিট সময় লাগে হাঁটু ভাঁজ করে বিছানা থেকে নামতে।


■■ আমাদের একমাত্র প্লেয়ার যে কিনা ইনজুরি বিধ্বস্ত অবস্থায় বোলিং এর কষ্টকে ভুলতে নিজেকে সান্ত্বনা দেন এই বলে “মুক্তিযোদ্ধারাপায়ে গুলি
নিয়েও যুদ্ধ করে যেতে পারলে আমি কেনো সামান্য অপারেশন নিয়েবোলিং করতে পারবো না।”

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *