বিশ্বের সবথেকে দুঃখজনক কয়েকটি বিমান দুর্ঘটনার গল্প

Source : Wall Street Journal

প্রথমেই বলে নেই, ২৪ ঘন্টার মধ্যে আপনি অথবা আপনার কোন প্রিয়জনের যদি বিমান যাত্রা করার সম্ভাবনা থেকে থাকে তাহলে এই আর্টিকেলটি না পড়ার জন্য। যদিও প্রতিদিন বিশ্বে হাজার হাজার বিমান আকাশে উড়ে এবং নিরাপদে কোন দূর্ঘটনা ছাড়াই অবতরণ করে। যদি আপনি বিমান দূর্ঘটনা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায়গ্রস্থ হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে আমি বলবো না করার জন্য। কারন বিমান দূর্ঘটনার আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার থেকে বরঞ্চ এয়ারপোর্ট যাওয়ার সময় গাড়িতে দূর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বেশি ঝুকি বহন করে থাকেন। এছাড়া বিমানের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি ফ্লাইটের পূর্বে অসংখ্য বিষয়ের নিরাপত্তা ইঞ্জিনিয়াররা পরীক্ষা করে থাকেন। তবে দূর্ঘটনায় যেকোন সময়ে ঘটে যেতে পারে। তেমনি অনাকাঙ্খিত বিমান দূর্ঘটনার ঘটনাগুলো নিয়ে আমাদের আজকের এই আর্টিকেল।

১. আমেরিকান এয়ারলাইন্স, ফ্লাইট নং ১৯১

দিনটি ছিলো শুক্রবার, ১৯৭৯ সালের মে মাসের ২৫ তারিখ। ২৭১ জন যাত্রী নিয়ে ডগলাস ডিসি – ১০ এয়ারক্র্যাফট শিকাগোর এয়ারপোর্ট থেকে যাত্রা করে। টেক অফের কিছুক্ষন পরেই যখন ডিসি – ১০ উড়োজাহাজটি রানওয়ে থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে তখন এর বাম পাশের ইঞ্জিনটি উড়োজাহাজটির ডানা থেকে খুলে যায় এবং ততক্ষণাৎ খসে পড়ে।

Source: Chicago Tribune

ইঞ্জিন খুলে যাওয়ার কারণে সাথে সাথে বিমানটি তার উড়ার শক্তি এবং ভারসাম্য হারায়। ফলে মিনিটের থেকে কম সময়ের মধ্যে মাটিতে ভূপাতিত হয় তখনকার সেরা বিমানের মধ্যে একটি ডগলাস ডিসি – ১০। ক্রাশের ফলে পুরো উড়োজাহাজটি আগুনের কুন্ডে পরিনত হয় এবং এর বহন করা ২৭১ জন যাত্রী ততক্ষণাৎ মৃত্যুবরন করে। এর আগুনের ভয়াবহতা আর ধোঁয়া এতটাই বেশি হয়েছিলো যে আট মাইল দূর থেকেও এর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিলো।

বিমানের সব যাত্রী ছাড়াও মাটিতে থাকা আরো দুইজন মানুষ এই দূর্ঘটনায় প্রান হারিয়েছিলো। পরবর্তীতে দূর্ঘটনার রিপোর্টে জানা যায়, ওই ফ্লাইটের পূর্বে বাম ইঞ্জিনটি রক্ষণাবেক্ষণের কাজে অপসারণ করা হয়েছিলো। আর তাড়াহুড়োর কারণে তখন ইঞ্জিনিয়াররা ইঞ্জিনটি ধরে রাখার জন্য বিমানের স্ট্রাকচারের এ্যলমুনিয়ামের পাতে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। যার ফলে এই দূর্ঘটনা ঘটেছিলো।

২. ইরানিয়ান এয়ার ফোর্স, ইলিউশন আইএল ৭৬

এই দূর্ঘটনাটি ঘটেছিলো ২০০৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। ইলিউশন আইএল ৭৬ মিলিটারী এয়ারক্র্যাফট ইরানের জাহিদান এয়ারপোর্ট থেকে ১৮ জন ইসলামিক রেভুলেশন গার্ড কপর্সের সদস্য নিয়ে কারমান এয়ারপোর্টের উদ্যেশ্যে যাত্রা করেছিলো। সেদিন আবহাওয়া ছিলো অত্যন্ত খারাপ আর সাথে ছিলো ঘন কুয়াশা।

Source: Air Force Ilyushin

আবহাওয়া খারাপের কারনে বিকাল ৫:৩০ তে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে হঠাৎ করে বিমানটির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর তার কিছুক্ষণ পর কারমানের দক্ষিণ পূর্ব পাশের সিরিচ পর্বতটিতে বিমানটি ক্রাশ করে। যেটা কিনা তেহরানের থেকে ৫০০ মাইল দূরে অবস্থিত। এই দূর্ঘটনায় বিমানের সকল যাত্রী মৃত্যুবরণ করেছিলো। পরবর্তীতে দুর্ঘটনার রিপোর্টে জানা যায়, পূর্ববর্তী ত্রুটি থাকায় এই বাজে আবহাওয়ায় বিমানটির গ্রাউন্ড প্রক্সিমেটরি সিস্টেম হঠাৎ করে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফলে পাইলট পাহাড়ের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ছিলোনা।

৪. মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, ফ্লাইট নং ১৭

এই দূর্ঘটনাটি ঘটেছিলো ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই। মালাইশিয়া এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭ মডেলের ২০০ সিরিজের বিমানটি সর্বমোট ২৯৮ জন যাত্রী নিয়ে আমস্টার্ডাম এয়ারপোর্ট হতে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলো। বিমানটি অবস্থান যখন পূর্ব ইউক্রেনের আকাশে তখন একটি সার্ফেস টু এয়ার মিসাইল এসে বিমানটিতে আঘাত হানে। মিসাইলটি ছিলো রাশিয়ান বিদ্রোহীদের।

Source : Wall Street Journal

তখন সেখানকার শিখতাস্কি অঞ্চলে যুদ্ধ চলছিলো। যেটা ডনবাস যুদ্ধের অন্যতম একটি লড়াই। মিসাইলের আঘাতে বিমানটি তোরেজের মাটি গিয়ে ভূপাতিত হয়। আর বিমানের প্রতিটি যাত্রী নিহত হয়। যদিও এর ঘটনার পূর্বে অনেক এয়ারলাইন্স কোম্পানি ইউক্রেনের আকাশপথ ব্যবহার বন্ধ রেখেছিলো। তবে এই ঘটনার পর সিভিল এভিয়েশন যাত্রী বিমানের জন্য সেখানকার আকাশপথ ব্যবহারে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

৫. সৌদি এয়াবিয়ান এয়ারলাইন্স, ফ্লাইট নং ১৬৩

এই দূর্ঘটনাটি অন্যান্য দূর্ঘটনা থেকে ভিন্ন। কারন এখানে ক্রাশ বা আকাশপথে বিস্ফোরণের মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। ১৯৮০ সালের আগষ্ট মাসের ঘটনা। লকহিড কোম্পানির এল – ১০১১ মডেলের বিমানটি ৩০১ জন যাত্রী নিয়ে রিয়াদ এয়ারপোর্ট থেকে যাত্রা করেছিলো জেদ্দা এয়ারপোর্টের উদ্যেশ্যে।

টেকঅফের সাত মিনিট পর ক্রুরা কার্গো ডিপার্টমেন্টে আগুন লাগার সর্তকবার্তা লক্ষ্য করেন। আর সেটা সঠিক এটা নিশ্চিত করতে ব্যয় করেন আরো চার মিনিট। যখন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার বিষয়টি ক্যাপ্টেনকে জানান তখন ক্যাপ্টেন জরুরি অবস্থার কথা ঘোষণা করেন ততক্ষণাৎ রিয়াদ এয়ারপোর্টে ফেরার চেষ্টা চালান। এরপর তিনি আবিষ্কার করেন দুই নম্বর ইঞ্জিনের থ্রাস্ট লিভার কাজ করছে না। কারন ততক্ষনে আগুন লেগে ইঞ্জিন অপারেটিং কেবল অকেজো হয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে অবতরণের সময়ে দ্বিতীয় ইঞ্জিন বন্ধ করে ক্যাপ্টেন বিমানটি নিরাপদের অবতরণ করাতে সক্ষম হন। কিন্তু বিপত্তি লাগে অবতরণের পরে।

Source : Wall Street Journal

রানওয়ের টাচডাউন করার পরও বিমানটি থামেনি। বরঞ্চ সেটা ট্যাক্সিং করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রানওয়ের বাহিরে গিয়ে ঠিক দুইমিনিট চল্লিশ সেকেন্ডে পর থামে। ক্যাপ্টেন অবতরণের পরপরই জরুরিভাবে বিমান থামায়নি কেন এবং এভাকিউশন শুরু করেনি কেন সেটা সবার কাছেই তখন রহস্য হয়ে দাড়ায়। কারন তখন জরুরি অবস্থার প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাসহ উদ্ধার কর্মীরা অপেক্ষা করছিলো। আর আশা করেছিলো টাচডাউনের সাথে সাথে জরুরি ভিত্তিকে বিমানটিকে থামানো হবে।

দ্বিতীয় বিপত্তিটি ঘটে ট্যাক্সিংয়ের পরে। বিমানটি থামার পরও বিমানের ডানায় থাকা দুইটি ইঞ্জিনই তখন চালু ছিলো। যার কারণে উদ্ধার কর্মীরা বিমানের কাছে ভিড়তে পারছিলো না। আরো তিন মিনিট পনের সেকেন্ড পার হওয়ার পর যখন ইঞ্জিন দুইটি থামলো তখন উদ্ধার কর্মীরা দ্রুত বিমানের কাছে পৌছে গেল আর বিমানের পিছনের অংশের জানালা দিয়ে ভিতরে আগুন লাগার বিষয়টি লক্ষ করলো। যেখানে থেকে প্রচুর পরিমানে ধোঁয়া নির্গত হয়েছিলো যা সকল যাত্রীর শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধাগ্রস্থ করে।

ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার প্রায় ২৩ মিনিট পর বিমানের ডান পাশের দুই নম্বর দরজাটি উদ্ধার কর্মীরা খুলতে সক্ষম হয়। আর তার তিন মিনিট পর হঠাৎ করে বিমানে আগুন লাগে এবং বিমানটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে যখন যখন তদন্ত রিপোর্ট বের হয় তখন জানা যায়, যাত্রীদের মৃত্যুর কারণ আগুন ছিলোনা। দরজা খোলার বহু আগেই ভিতরের সকল যাত্রী শ্বাসকষ্টে মারা গিয়েছিলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *